ট্রাক্টরের ধাক্কায় একজন নিহত : বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসীর হামলায় ইউএনও রক্তাক্ত

চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে জরিমানার নামে ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাটি কাটার অনুমতি দেয়ার গুঞ্জন

মাটি-বালু কাটা ও মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল বন্ধ এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ
স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় ইটভাটার মাটি বহনকারী ট্রাক্টরের চাপায় এক বাইসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে তুলকালাম কা- ঘটেছে। লাশ নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিম লিংকন রক্তাক্ত জখম হয়েছেন। এসময় তিনি ঘটনাস্থলের পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলে বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে দীর্ঘক্ষণ অবরুদ্ধ করে রাখে। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে হাসাদহ ইউনিয়নের কাটাপোল গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। পরে বেলা সোয়া ১ টায় অবরুদ্ধ থাকা আহত অবস্থায় ইউএনওকে উদ্ধার করার পর তাকে উপজেলার সরকারি বাসভবনে এনে চিকিৎসা দেয়া হয়। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তির নাম মঈদুল ইসলাম (৩৪)। তিনি ঝিনাইদহের মহেশপুর উপজেলার শঙ্করহুদা-বাথানগাছি গ্রামের মৃত সমসের বিশ্বাসের ছেলে। নিহতের ৭ বছর বয়সী ছেলে রাসেলকে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। সন্ধ্যায় চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম সরকার আহত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে দেখতে তার বাসভবন জীবননগরে যান এবং ঘটনার বিস্তারিত বর্ননা শোনেন। এর আগে ওই ঘটনার খবর পেয়ে চুয়াডাঙ্গার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) তারেক আহম্মেদ এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) জাহাঙ্গীর আলম ঘটনাস্থল পরিদর্শনে করেন। এ সংবাদ লেখার সময় ঘটনার ব্যাপারে মামলা প্রক্রিয়াধীন ছিলো।
পুলিশ ও স্থানীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে মঈদুল তার ছেলেকে নিয়ে বাইসাইকেলে করে শ্বশুরবাড়ি জীবননগর উপজেলার নতুন চাকলা গ্রামে যাচ্ছিলেন। কাটাপোল দক্ষিণপাড়ায় ইটভাটার মাটিবাহী ট্রাক্টরের ধাক্কায় বাবা-ছেলে আহত হয়। এর কিছুক্ষণ পরই মঈদুল মারা যান। পুলিশ আহত শিশু রাসেলকে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করায়। এ ঘটনার পরপর স্থানীয় জনতা মাটি-বালু কাটা ও মাটিবাহী ট্রাক্টর চলাচল বন্ধ এবং দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। বিক্ষোভ চলাকালে গ্রামবাসীদের মধ্যে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ইউএনও মুনিম লিংকন ৭০ হাজার টাকার বিনিময়ে মাটি কাটার অনুমতি দিয়েছেন এবং সেই মাটি বহনকারী ট্রাক্টরের ধাক্কায় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে।
এলাকাবাসী জানায়, কাটাপোল গ্রামের মাঠ হতে মাটি ও বালু উত্তোলন করে দেদারছে ইটভাটায় বিক্রি করছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এ মাটি নেয়াকালে প্রতিদিনই অর্ধশত ট্রাক্টর ওই রাস্তা দিয়ে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করার সময় প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এনিয়ে ওই এলাকাবাসী চরম বিক্ষুদ্ধ ছিলেন। এর প্রতিকার চেয়ে গ্রামবাসী প্রশাসনের নিকট আবেদন করে। আবেদনের প্রেক্ষিতে জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মুনিম লিংকন ৯ মার্চ অবৈধভাবে বালু কাটার অপরাধে বাঁকা গ্রামের এলাহী মালিথার ছেলে আলামিনকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করেন। এঘটনার পর আলামিনসহ তার অনুসারীরা ওই এলাকার লোকজনের মধ্যে অপপ্রচার করে যে, আমরা ৭০ হাজার টাকা দিয়ে ইউএনওকে কিনে ফেলেছি। এবার প্রতিদিন দ্বিগুন পরিমাণ বালি কাটবো। আমাদের আর কেউ কিছু করতে পারবে না। এ অপপ্রচারের কারণে ওই এলাকাবাসী জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্তকর্তা এসএম মুনিম লিংকনের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।
এ অবস্থার মধ্যে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর উপজেলার শঙ্করহুদা-বাথানগাছি গ্রামের মঈদুল ইসলাম তার ৭ বছরের শিশু সন্তান রাসেলকে নিয়ে বাইসাইকেলযোগে শ্বশুরবাড়ি জীবননগর উপজেলার নতুন চাকলা গ্রাম থেকে ভাইরাভাইয়ের বাড়ী মিনাজপুর গ্রামে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে কাটাপোল গ্রামে দক্ষিণপাড়ায় তারা পৌঁছুলে ট্রাক্টরের ধাক্কায় পিতা-পুত্র দু’জনেই আহত হয়। দুর্ঘটনায় মঈদুলের মাথার ঘিলু বের হয়ে পড়ে এবং ছেলে রাসেলের হাত-পা ভেঙে যায়। আহত রাসেলকে উদ্ধার করে জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলেও দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে ঘটনাস্থলে মঈদুল ইসলাম কাতরাতে থাকলেও বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নিতে দেয়নি এবং এ ঘটনায় বিক্ষুদ্ধ গ্রামবাসী সড়কও অবরোধ করে রাখে।
পুলিশ লাশটি উদ্ধার করতে গেলে গ্রামবাসীরা সোজা জানিয়ে দেন, লাশটি নিতে হলে ইউএনওকে কাটাপোল গ্রামে আসতে হবে। খবর পেয়ে ইউএনও মুনিম লিংকন গ্রামটিতে পৌঁছে বিক্ষুব্ধ জনতার রোষানলে পড়েন। অবস্থা বেগতিক বুঝতে পেরে তিনি সেখান থেকে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে গেলে উত্তেজিত জনতার নিক্ষিপ্ত ইটের আঘাতে মাথায় আঘাত পান। রক্তাক্ত অবস্থায় তিনি স্থানীয় জমির উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। বিক্ষুব্ধ গ্রামবাসী ওই বাড়ি ঘেরাও করে ইউএনওকে অবরুদ্ধ করে রাখেন এবং বাড়িতে ইটপাটকেল ছোঁড়েন। জীবননগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. হাফিজুর রহমান ঘটনা জানার পর দ্রুত ঘটনাস্থলে যান এবং পুলিশের সহযোগিতায় বিক্ষুব্ধ জনতাকে শান্ত করে অবরুদ্ধ ইউএনওকে উদ্ধার করে তার বাসভবনে নেন। জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসক সেলিনা আখতার জানান, ইউএনও আশঙ্কামুক্ত।
আহত জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মুনিম লিংকন জানান, লোক মারফর খবর পেয়ে দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত মঈদুল ইসলামকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেবার জন্য অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে আমি ঘটনাস্থলে যায়। আমি গাড়ী থেকে নামার পরই শতাধিক লোক আমাকে ঘিরে ধরেন। এসয় বিক্ষুদ্ধ জনতা আমার ওপর হামলা চালায়। এসময় আমি প্রাণ বাঁচাতে দৌঁড় দিলে বিক্ষুব্ধ লোকজন আমাকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে। এসময় একটা ইট আমার মাথায় লাগলে আমি রক্তাক্ত হয়। অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে আমি পার্শবর্তী জমির উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নিই। এ সময় বিক্ষুব্ধ লোকজন ওই বাড়িতেও দফায় দফায় আমার ওপর হামলা করার চেষ্টা চালায়। খবর পেয়ে জীবননগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজি মো. হাফিজুর রহমান দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ লোকজনকে শান্ত করেন এবং কৌশলে আমাকে উদ্ধার করে আমার সরকারি বাসভবনে পৌঁছিয়ে দেন।
জীবননগর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজি মো. হাফিজুর রহমান জানান, তিনি খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন তিন শতাধিক মানুষ ইউএনওকে একটি বাড়িতে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। বিক্ষুব্ধ লোকজন খুবই উত্তেজিত ছিলো। আমি কৌশলে ইউএনওকে উদ্ধার করে তার বাসভবনে নিয়ে আসি এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করি।
জীবননগর থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহোদয় ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর ৫ মিনিট আগেই আমি ঘটনাস্থলে পৌঁছায়। আমি বিক্ষুব্ধ লোকজনকে শান্ত করার পর আহত মঈদুল ইসলামকে দেখতে যায়। এসময় ইউএনও মহোদয় গাড়ী থেকে নামার পরই উত্তেজিত লোকজন তার ওপর হামলা চালান।
জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা সেলিনা আখতার সুমি জানান, ভারী বস্তু দিয়ে ইউএনও মহোদয়ের মাথায় আঘাত করা হয়েছে। এ জন্য মাথা দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত। অপরদিকে আহত মইদুল ইসলামকে হাসপাতালে ভর্তি করার ১০ মিনিট পরই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
জেলা প্রশাসক নজরুল ইসলাম সরকার জানান, বেলা সাড়ে ১১ টার দিকে জীবননগর উপজেলার কাটাপোল গ্রামে মজিবর রহমান তার জমিতে পুকুর খননের নামে অবৈধভাবে মাটি উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাক্টরের চাকায় পিষ্ট হয়ে মঈদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি নিহত ও তার ৭ বছরের পুত্র ইয়াসিন গুরুতর আহত হয়। এ ঘটনায় জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনিম লিংকন ঘটনাস্থলে পৌঁছালে স্থানীয় জনতার জনরোষে পড়েন এবং আহত হন।
তিনি আরো বলেন, গত শনিবার বালি উত্তোলনকারী মজিবর রহমান ওরফে মন্টু মাস্টারকে ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে পুকুর খননের নামে মাটি উত্তোলন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সে আবারও ২০টি ট্রাক্টর লাগিয়ে বালি উত্তোলন করছিলো। এ সময় তার বালির গাড়িতে চাপা পড়ে একজন নিহত হলে এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। তিনি জানান, এ ঘটনায় দোষীদের বিরুদ্ধে হত্যা ও রাষ্ট্রীয় কাজে বাধাদানের অভিযোগে দুটি মামলা করা হবে। দোষীদের ধরতে পুলিশ প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
পুলিশ সুপার মো. জাহিদুল ইসলাম জানান, জড়িতদের ধরতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ।
এদিকে স্থানীয় গ্রামবাসী জানান, কাটাপোল গ্রামের আনারে ম-লের ছেলে শাখাওয়াত হোসেন, সোনা বিশ্বাসের ছেলে মিলন ম-ল, মৃত রওশন আলীর ছেলে আব্দুস সালাম, রেজাউল ইসলামের ছেলে রিপন, হাসাদাহ বাজারের অলিম, শুকুরসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র বেশ কিছুদিন ধরে এলাকার বিভিন্ন মালিকানা জমি থেকে এবং সরকারি খাল হতে অবৈধভাবে মাটি ও বালি কেটে ইটের ভাটায় বিক্রি করে আসছিলো। বিশেষ করে জীবননগরের আওয়াল ব্রিকস, কানাইডাঙ্গা গ্রামের আলম ব্রিকস এবং মাধবপুর গ্রামের হান্নান হুজুরের ইটের ভাটায় মাটি ও বালু বিক্রি করা হতো। প্রতিদিন ৫০-৬০টি ট্রাকে করে বেপরোয়া গতিতে মাটি আনা নেয়া করা হতো। এতে ওই এলাকার লোকজন চরম ক্ষুব্ধ হলেও ওই সংঘবদ্ধ চক্রের বিরুদ্ধে ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেনি। ওই চক্রের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুললে বা প্রতিবাদ করলে প্রকাশ্যে তাদেরকে বিভিন্ন ধরনের হুমকি দেয়া হতো।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More