বজ্রপাতে প্রাণ গেলো ১০ জনের : ফসলের ব্যাপক ক্ষতি

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুরসহ সারাদেশে কালবৈশাখী : লণ্ডভণ্ড কাঁচা ঘরবাড়ি

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গা ও কুষ্টিয়াসহ বেশ কিছু জেলায় শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গতকাল শনিবার দিনভর ছিলো তাপদাহ। বিকেল গড়াতেই আকাশ কালো করে মেঘ হয়ে দমকা হাওয়া ও বৃষ্টি শুরু হয়। ঝড়বৃষ্টির সময় বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জন। আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, আজ রোববারও দেশের বিভিন্ন জেলায় ঝড়বৃষ্টি হতে পারে। মে মাসেও দেশে তাপপ্রবাহ অব্যাহত থাকবে। তাপমাত্রা আবার ৪০ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে।

চুয়াডাঙ্গায় কালবৈশাখী ঝড়ে ল-ভ- হয়েছে বেশ কিছু কাঁচা ও আধাপাকা ঘরবাড়ি। ২০ মিনিটের এই ঝড়ে উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বড় বড় গাছ ভেঙে বিদ্যুতের তারে পড়ায় অনেক এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৩ কিলোমিটার বেগে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। শনিবার চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রার পারদ উঠেছে ৩৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বৃষ্টি থামার পর থেকেই গরমে ঘামছে শরীর। বজ্রপাতে দামুড়হুদা উপজেলার ভগিরতপুর গ্রামে বজ্রপাতে মিনারুল ইসলাম (৬৫) নামে এক কৃষক আহত হয়েছেন। তাকে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়েছে। সদর উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঝড়ে বেশ কিছু গাছ পড়ে গেছে। প্রচুর আম গাছ থেকে ঝরে পড়েছে। কালবৈশাখীর সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে মাঠের ফসল, গাছগাছালি ও কাঁচা বাড়িঘরের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকায় গাছ ভেঙে তারের ওপর পড়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। মেহেরপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চুয়াডাঙ্গা জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার কাজি মোছা. আয়শা সিদ্দিকা সরকার জানান, কালবৈশাখীর কারণে গাছ উপড়ে পড়ে বিদ্যুতের তার ছিড়ে গেছে। অনেক জায়গায় গাছ তারের ওপর পড়ে থাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সদর উপজেলার আলুকদিয়া ইউনিয়ন এলাকা। আয়শা সিদ্দিকা আরও বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত লাইন সচলে আমরা কাজ করছি। আশা করছি খুব দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা সম্ভব হবে।

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিনুর রহমান বলেন, বিকেলে চুয়াডাঙ্গার ওপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে যায়। ২০ মিনিট স্থায়ী এই ঝড়ের গতি বেগ ছিলো ঘণ্টায় ৪৩ কিলোমিটার। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৮ মিলিমিটার। এদিকে, জেলার তিন উপজেলা চুয়াডাঙ্গা সদর, দামুড়হুদা ও জীবননগরের নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কোনো উপজেলায় এই ঝড়ে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আর আলমডাঙ্গা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার মোবাইলফোন নম্বরটি বন্ধ থাকায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এ প্রসঙ্গে চুয়াডাঙ্গা জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনিসুজ্জামান লালন বলেন, জেলার বিভিন্ন স্থানে ঝড় বৃষ্টি হয়েছে। তবে প্রাণহানিসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির কোনো খবর পাইনি। তারপরও থানাগুলোর প্রত্যন্ত অঞ্চলে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। রাত থেকেই বাড়তি নিরাপত্তাসহ জনগণের ভোগান্তি নিরসনে কাজ করছে পুলিশ সদস্যরা। চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিভাস চন্দ্র সাহা বলেন, এই ঝড়ে চুয়াডাঙ্গা জেলায় মরসুমি ফসলের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। আমরা নিরুপণ করে জানাবো। তবে এই ঝড়ের অতোটা তীব্রতা ছিলো না। তিনি বলেন, আজকের বৃষ্টিপাতের কারণে ধানের বীজতলা ও আমের জন্য বেশ ভালো হবে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে শুকিয়ে যাওয়া আমের বোটায় রস পাবে আর বীজতলাও রস পাবে। অপরদিকে, চুয়াডাঙ্গা দামুড়হুদা উপজেলার ভগিরতপুর গ্রামে বজ্রপাতে মিনারুল ইসলাম (৬৫) নামে এক কৃষক আহত হয়েছেন। তাকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেলে গ্রামের একটি মাঠে ধান কাটার সময় এ ঘটনা ঘটে। আহত মিনারুল ইসলাম উপজেলার নতিপোতা ইউনিয়নের ভগিরতপুর গ্রামের ব্রিজপাড়ার মৃত বুদো বিশ্বাসের ছেলে। স্থানীয়রা জানান, গতকাল বিকেলে একই গ্রামের আলমের ছেলে বখতিয়ারের ধান কাটছিলেন বৃদ্ধ মিনারুল। এ সময় তার কাছাকাছি স্থানে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। এতে বজ্রপাতের শব্দে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ভর্তি করেন। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক নূর জাহান খাতুন দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, ওই বৃদ্ধকে হাসপাতালে অচেতন অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছিলো। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ভর্তি রেখে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তবে তিনি শঙ্কামুক্ত কিনা এখনি বলা সম্ভব না।

জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, দ্বিতীয় দিনের মতো জীবননগরে দমকা হাওয়া, বৃষ্টি ও বজ্রপাতের ঘটনা ঘটেছে। গতকাল শনিবার বিকেলে মুসলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। প্রায় আধাঘণ্টা স্থায়ী হয় বৃষ্টি। মুসলধারে বৃষ্টির ফলে মাঠে কেটে রাখা পাকা ধানের ক্ষেতে পানি জমে গেছে। এর ফলে ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষক। ঝড়ের ফলে গাছের আম আবারও ঝড়ে পড়েছে। ফলে চরম ক্ষতির মুখে আম চাষীরা। এছাড়াও দমকা হাওয়া ও ঝড়ের ফলে ভেঙ্গে গেছে গাছ-গাছালির ডালপালা ও টিনের ছাউনী। এ সময় বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতে হতাহতের কোন খবর পাওয়া না গেলেও উপজেলার খয়েরহুদা গ্রামের মাঠে তাল ও নারিকেল গাছে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। এর পূর্বে গত বুধবার রাতে কাল বৈশাখী ঝড় ও শিলা বৃষ্টির ঘটনা ঘটে। গতকাল বিকেল থেকেই আকাশে মেঘের ঘনঘটা শুরু হয়। ৫টার দিকে শুরু হয় দমকা হাওয়া ও সেই সাথে মুসলধারে বৃষ্টি। প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলে এ বৃষ্টি। বৃষ্টির ফলে মাঠে কেটে রাখা পাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। এর ফলে ধান বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছে কৃষক। দমকা হাওয়া ও ঝড়ের কারণে দ্বিতীয় বারের মত আম ঝড়ে পড়ে বলে আম চাষিরা জানিয়েছে। ঝড়ের কারণে গাছ-গাছালির ডালপালা ভেঙ্গে পড়ে ও টিনের ঘরের ছাউনী উড়ে টিনের চালা। এ সময় ব্যাপক বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতে হতাহতের কোন খবর পাওয়া না গেলেও উপজেলার কেডিকে ইউনিয়নের খয়েরহুদা গ্রামের মাঠে একটি তালগাছ ও নারিকেল গাছে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতের ফলে এ সময় গাছ দুটিতে আগুন ধরে যায়। মুহূর্তের মধ্যে গাছ দুটি পুড়ে ভস্মিভূত হয়। এ ছাড়াও বাঁকা প্রতাবপুর মসজিদের একটি নারিকেল গাছে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। বজ্রপাতের ফলে মসজিদটির বৈদ্যুতিক লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হয় বলে খবর পাওয়া গেছে। এদিকে শেরপুরের শ্রীবরদীতে বজ্রপাতে এক দিনমজুরের প্রাণ গেছে। এতে আহত হয়েছে তার দুই শিশু মেয়ে। এ ছাড়া পাবনায় বজ্রপাতে এইচএসসি পরীক্ষার্থীসহ তিনজন, সিরাজগঞ্জে তিনজন, বগুড়া, পিরোজপুর, বরগুনা ও যশোরে একজন করে নিহত হয়েছেন। শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার কাকিলাকুড়া ইউনিয়নে শনিবার বিকেলে বজ্রপাতে এক দিনমজুর মারা গেছেন। মিজু মিয়ার (৩০) বাড়ি চিথলিয়া দক্ষিণ গ্রামে। বজ্রপাতে তার দুই শিশু মেয়ে মিম ও মল্লিকা গুরুতর আহত হয়েছে। তারা দু’জনই পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। পাবনায় বজ্রপাতে আটঘরিয়ায় এইচএসসি শিক্ষার্থী ও আমিনপুরে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। বিকেলে এ ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন আটঘরিয়া উপজেলার একদন্ত ইউনিয়নের বাড়ইপাড়া গ্রামের আব্দুল মজিদের ছেলে ও পাবনার সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের এইচএসসি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র এনামুল হক (১৮), আমিনপুরের চরগোবিন্দপুর গ্রামের কালা প্রামাণিকের ছেলে মনিরুজ্জামান জলম (৪০) ও রানীনগর ইউনিয়নের টাকিগাড়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম (৪২)। সিরাজগঞ্জে বজ্রপাতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে দুজন কৃষক এবং একজন গৃহবধূ। গতকাল শনিবার বিকেলে সিরাজগঞ্জ সদর ও কাজিপুর উপজেলায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। কাজিপুরে মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফেরার পথে দুটি গরুসহ এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। উপজেলার শুভগাছা ইউনিয়নের চরাঞ্চলের চরবড়বাড়িয়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত গৃহবধূ সীমা খাতুন ওই গ্রামের শাহীনের স্ত্রী। কাজিপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুখময় সরকার জানান, ঝড়োবৃষ্টির মধ্যে সীমা মাঠ থেকে গরু নিয়ে ফেরার পথে বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়। একই সময়ে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলী ইউনিয়নের বাগডুমুর গ্রামে ধান কেটে বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন সদর উপজেলার বহুলী ইউনিয়নের বাগডুমুর গ্রামের নাছিম খানের ছেলে আব্দুল মালেক ও একই গ্রামের আব্দুল মজিদ শেখের ছেলে সোলেমান শেখ। বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলায় বজ্রপাতে লোকমান আলী (৬০) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। বিকেলে উপজেলার বুড়ইল ইউনিয়নের সিংজানী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। লোকমান আলী মাঠে ঘাস কাটতে গিয়েছিলেন। কুষ্টিয়ায় শিলাবৃষ্টি হয়েছে। তিন বছর পর বাসিন্দারা শিলাবৃষ্টি দেখতে পেলো। শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে এই ঝড়বৃষ্টি হয়। হরিপুর ইউনিয়নে বোরো ধান ও আমের ক্ষতি হয়েছে। বরগুনার পাথরঘাটায় মাঠ থেকে গরু আনতে গিয়ে কৃষক খলিলুর রহমান মারা যান। তিনি ওই উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের তাফালবাড়িয়া এলাকার মৃত লেহাজ উদ্দিনের ছেলে। পাথরঘাটা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহ্ আলম হাওলাদার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, দুপুর ২টার দিকে বাড়ির পাশে ধান খেতের মাঠে থাকা গরু আনতে যান খলিল। গরু নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বজ্রপাতে তার মৃত্যু হয়। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় বজ্রপাতে হোসনেয়ারা বেগম (৪০) নামের এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে শনিবার দুপুরে উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের নলী জয়নগর গ্রামে। নিহত হোসনেয়ারা বেগম ওই গ্রামের আব্দুল ছালাম এর স্ত্রী। নিহতের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ওই দিন দুপুরে সাড়ে তিনটার দিকে বৃষ্টি শুরু হয়। এ সময় তাদের নিজ বাড়ির পিছনের মাঠে ঘাস খেতে থাকা গরু আনতে যান ওই গৃহবধূ। এ সময় বজ্রপাতে গৃহবধূর মৃত্যু হয়।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More