বাগেরহাটের বিল্লালকে ফাঁসাতে মেহেরপুরের পারুলকে খুন, নেপথ্য উন্মোচন

সন্তান গ্রামের বাড়ি রেখে সাভারে পোশাক তৈরি করে রাস্তায় ঘুরে বিক্রি করতো পারুলা বেগম। ভালোই চলছিলো তার দিন। একা জীবনে হাঁপিয়ে ওঠেন একসময়। সেই সুযোগ নিয়ে যে কেউ তাঁকে হত্যা করতে পারে, সে কথা কে জানত। আজ সোমবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এক সংবাদ সম্মেলনে খুনি কী করে শনাক্ত হলো, সে খবর জানিয়েছে।
পিবিআইয়ের উপমহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সাভারের বক্তারপুরের এই খুনের পরিকল্পনা হয় বাগেরহাটের মোংলার চিলায় বসে। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে সামনে রেখে কাউন্সিলর প্রার্থী ও সাবেক কাউন্সিলর মো. হালিম হাওলাদার ছক কষেন। প্রতিপক্ষ বিল্লাল সরদারকে খুনের মামলায় ফাঁসাতে পারলে সহজেই জিতবেন, এই ছিল ভাবনা। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হালিম হাওলাদার ৩০ হাজার টাকায় চুক্তি করেন পিরোজপুরের জামাল হাওলাদারের সঙ্গে। জামাল আবার জোট বাঁধেন দরজি মাস্টার মশিউর রহমান ওরফে মিলন কবিরাজের সঙ্গে। বনজ কুমার মজুমদার বলেন, খুনের জন্য তাদের পছন্দ ছিল এমন কেউ, যার মৃত্যুতে কোনো চাঞ্চল্য হবে না বা কেউ তদবির করবে না।
সংবাদ সম্মেলনে একটি অডিও ক্লিপ শোনানো হয়। ওই ক্লিপে বলতে শোনা যায়, ‘বিল্লাল যদি গ্রেপ্তার না হয়, প্রথমে একজন রিকশাওয়ালা মারব, তাতেও না হলে আরেকজন মহিলা মারব।’ পারুল বেগমের গ্রামের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনীতে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিল। শিশুদের পোশাক হাতে সেলাই করে বিক্রি করতেন। কাজের সূত্রেই পরিচয় দরজি মাস্টার মো. মশিউর রহমান ওরফে মিলন কবিরাজের সঙ্গে। মিলন কবিরাজ সেলাইয়ের পাশাপাশি তুকতাক করেন। হাজারো মানুষের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। একজন ‘নির্ভেজাল’ মানুষকে খুনের নিশানা করতে পিরোজপুরের জামাল হাওলাদার তাই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
*শ্রমজীবী পারুল খুন হন সাভারে
*পরিকল্পনা হয় বাগেরহাটের মোংলায় *ইউপি নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে খুনের মামলায় ফাঁসাতে ছক কষেন সাবেক কাউন্সিলর
*ঘটনাস্থল থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া যায় *মামলায় ফাঁসাতে দরিদ্র মানুষকে নিশানা করা হচ্ছে পারুলের সঙ্গে জামালের পরিচয় হয়। তাঁরা পরস্পরকে বিয়ে করবেন সিদ্ধান্ত নেন। সে অনুযায়ী সাভারের বক্তারপুরের একটি টিনশেড বাসায় ওঠেন ৭ সেপ্টেম্বর। রাত আটটার দিকে খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমিয়ে পড়েন। অনেক বেলা হয়ে গেলেও কেউ উঠছেন না দেখে বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ডাকাডাকি করেন। বাসার পেছনে গিয়ে তিনি দেখেন গ্রিলের জানালা ওঠানো। ভেতরে পারুলের লাশ পড়ে আছে। পাশে একটা ফোন ও বিল্লাল সরদারের জাতীয় পরিচয়পত্রের একটি অনুলিপি। জামাল হাওলাদার উধাও। হত্যাকাণ্ডের পর পারুলের ভাই মমিনুল হক ওরফে মোহন অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে সাভার মডেল থানায় মামলা করেন। থানা ১১ দিন ওই মামলার তদন্ত করে। পরে পিবিআই ঢাকা জেলা নিজ উদ্যোগে তদন্ত শুরু করে।
পিবিআই দূর থেকে বিল্লাল সরদারকে অনুসরণ করেছিল। একসময় তারা নিশ্চিত হয় এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে বিল্লালের সম্পৃক্ততা নেই। পরে তারা তার (বিল্লাল) সঙ্গে কথা বলে। বিল্লাল বলেন, তিনি নির্বাচন করছেন, সে কারণে তাঁকে ফাঁসাতে কেউ এমন কিছু করে থাকতে পারে। বেশ কয়েকজন সন্দেহভাজনের নাম দেন তিনি। অনেক যাচাই-বাছাইয়ের পর তারা আসামিদের শনাক্ত করে। নিশ্চিত হওয়ার পরও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হালিম হাওলাদারকে গ্রেপ্তার করেনি পিবিআই। তারা নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে। নির্বাচনে বিল্লাল ও হালিম দুজনই হেরেছেন। পিবিআই ২২ সেপ্টেম্বর মো. জামাল হাওলাদারকে ঢাকার লালবাগ থেকে, পরদিন মিলন কবিরাজকে দারুস সালামের লালকুঠি মাজার রোড থেকে ও ২৬ সেপ্টেম্বর ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী হালিম হাওলাদারকে মোংলা থেকে গ্রেফতার করে। দুজন আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বনজ কুমার মজুমদার বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করতে গিয়ে তাঁদের মনে হয়েছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ নিশানা হচ্ছেন।
তিনি প্রশ্ন রাখেন, হত্যা পরিকল্পনাকারীরা কি ধরে নিয়েছেন দরিদ্রদের খুন করলে পার পাওয়া যাবে? নইলে যাদের অতীতে কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রমাণ নেই, তারা কেন খুনে জড়ায়? দরিদ্ররাই বা কেন নিশানা হন? পিবিআইপ্রধান বলেন, তাঁরা এমন খুনের ঘটনাগুলোর তদন্ত করে যাবেন এবং অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতে কাজ করে যাবেন।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More