জবাবদিহি ও কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে

সম্পাদকীয়

দেশে স্বাস্থ্যসেবা খাতে দীর্ঘদিন ধরে যা চলছে তাকে অরাজকতা বললে অত্যুক্তি হবে না। বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিয়ে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআর,বি) পরিচালিত এক গবেষণায় তা আরেকবার স্পষ্ট। দেশের বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর মধ্যে মাত্র ৬ শতাংশের নিবন্ধন রয়েছে। ২০১৯-২০ সালে দেশের ১২ সিটি করপোরেশন এবং ১০ জেলার ২৯টি উপজেলায় পরিচালিত গবেষণায় দেখা যায় গবেষণার আওতাভুক্ত এক হাজার ১১৭টি বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৯৫৬টি এক সময় নিবন্ধন করলেও মেয়াদ পার হওয়ার পর আর ওইমুখো হয়নি। ১৬১টি প্রতিষ্ঠান কখনোই নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেনি।

বলে রাখা দরকার, বেসরকারি গবেষণাটি দুই বছর আগে পরিচালিত হলেও এরমধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে; এমন দাবি সম্ভবত সরকারও করবে না। কারণ গত কিছুদিন ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অনিবন্ধিত স্বাস্থসেবা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যে অভিযান চালাচ্ছে; তার অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। এমনকি বড় বড় হাসপাতালও নিবন্ধন নবায়ন করেনি। শুধু তাই নয়; বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিবন্ধনহীন থাকার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট মালিকদের পক্ষ থেকে যখন ১৯৮২ সালের আইনের বিভিন্ন কঠোর শর্তকে দায়ী করা হয়েছে, তখন সেগুলো বাতিল করে সবার প্রতি নিজ নিজ স্বাস্থ্যকেন্দ্র নিবন্ধনের কাজ দ্রুত শেষ করার আহ্বান জানানো হয়।

এরপরও যে অনেক বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে নিবন্ধনের আওতায় এসেছে, তা বলা যায় না। অথচ নিবন্ধন হলো যে কোনো প্রতিষ্ঠানের জবাবদিহি ও কাজের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ। অর্থাৎ নিবন্ধনহীনভাবে কোনো প্রতিষ্ঠানকে কার্যক্রম চালাতে দেয়ার মানে হলো প্রতিষ্ঠানটির শুধু মালিক নয়; কর্মীদেরও খেয়াল-খুশিমতো চলতে দেয়া। এর ফলে গুরুত্বপূর্ণ খাতটি ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের মর্জির ওপর ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। নিবন্ধন না থাকলে জবাবদিহির প্রশ্ন যেমন অস্পষ্ট থাকে, তেমনই ভুল বা অপচিকিৎসার ঝুঁকিও থাকে ষোল আনা। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, বর্তমানে বিশেষ করে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ উদ্বেগজনক পরিস্থিতিই বিরাজমান।

আমরা জানি, দেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮০-এর দশকে। পরবর্তী সময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ খাতের বিকাশ ঘটেছে। প্রথমে বড় শহরগুলোতে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক দেখা গেলেও, একটা সময়ে একেবারে উপজেলা পর্যায়ে ব্যাঙের ছাতার মতো তা ছড়িয়ে পড়ে। এখানে জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নতুন নতুন উদ্যোক্তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, এটা অস্বীকার করার জো নেই- সরকারের দিক থেকে উপযুক্ত নজরদারির অভাব যত্রতত্র এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সহায়তা করেছে।

তা ছাড়া একই সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপত্র মেনে এবং নয়া উদারীকরণ নীতি অনুসরণ করতে গিয়ে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ ক্রমেই কমিয়ে আনার বিষয় মাথায় রাখতে হবে। এ নীতির কারণে এক সময়ে মানসম্মত সেবার জন্য জনপ্রিয় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবার মান অনিয়ম-অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে দারুণভাবে নেমে যায়। অন্যদিকে নতুন সরকারি হাসপাতাল তৈরির হারও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমে যায়।

আমাদের দেশে স্বাস্থ্যসেবায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী বিষয়। এর মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে শুধু নতুন বিনিয়োগই আসেনি; অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তিরও সমাবেশ ঘটেছে। তবে শঙ্কার বিষয় হলো, যেখানে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের পরিপূরক হওয়ার কথা, সেখানে এ খাতে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতের রীতিমতো আধিপত্য চলছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে এ খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা অংশের দায়িত্বহীনতা ও দুর্নীতি। আইসিডিডিআর, বির ওই গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে, বর্তমানে দেশের ৮০ শতাংশ মানুষ বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভরশীল। স্বাস্থ্যসেবা শুধু মৌলিক একটা সেবা নয়, অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয় বটে। কারণ মানুষের জীবনমরণ প্রশ্ন এখানে জড়িত। এখানে অরাজক পরিস্থিতি চলতে পারে না। সরকার বিষয়টা উপলব্ধি করেই নিবন্ধনহীন বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে। আমাদের প্রত্যাশা- প্রতিষ্ঠানগুলো জবাবদিহির আওতায় না আসা পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More