সিন্ডিকেটের কবলে চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারের মাংস ব্যবসা

পানি দিয়ে বাড়ানো হয় মাংস ও ভূঁড়ির ওজন!

স্টাফ রিপোর্টার: সিন্ডিকেটের কবলে চলে গেছে চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারের মাংসের বাজার। হঠাৎ করেই কেজিতে ৭০ থেকে ৮০ টাকা বেড়ে ৬০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে গরুর মাংসের দাম। আর ছাগলের মাংসের দাম সর্বনিম্ন ৭০০ টাকা থেকে শুরু হয়ে যার কাছে যেমন নেয়া যায়। এক্ষেত্রে খাসি, পাটি, ধাড়ি ছাগল সমানে সমান। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে গরু ছাগলের সরবরাহ কম হওয়ায় দাম বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়েছেন তারা। তবে জেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের তথ্য অনুসারে জেলায় চাহিদার চেয়েও খামারি পর্যায়ে বেশি গবাদিপশু রয়েছে। আর ক্রেতাদের দাবি ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারণেই মাংসের এ অযৌক্তিক দাম বেড়েছে। এ পরিস্থিতির জন্য সরকারিভাবে বাজার তদারকির অভাবকেই দায়ী করেছেন সাধারণ মানুষ। আবার দাম বেশি দিয়েও ভালোমানের মাংস মিলছে না এই বাজারে। অভিযোগ রয়েছে গরু, ছাগল জবাইয়ের পর মাংসের ওজন বাড়ানোর জন্য ঘন্টাখানেক সময় ধরে পানিতে ভেজানো হয়। এমনকি নাড়ি ভূঁড়িও বালতির পানিতে চুবিয়ে করা হয় দ্বিগুন ওজন। আর বিশেষ কায়দায় পাটি ছাগলের মাংস হয়ে যায় ১নং খাসির মাংস!
গত সপ্তাহে চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারে প্রতি কেজি গরুর মাংস বিক্রি হতে দেখা যায় ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে। অথচ সেই মাংসের দাম এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজি গরু ৬০০ টাকা। ছাগলের মাংস ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। বাজারে মাংস কিনতে আসা শহরের হাসপাতালপাড়ার বাসিন্দা সৈয়দ আবু জাফর বলেন, এমন অরাজক পরিস্থিতি মেনে নেয়া যায় না। কোনো ঘোষণা ছাড়াই কেজিতে ৬০ থেকে ৭০ টাকা দাম বৃদ্ধি। অথচ কেউ দেখার নেই। বাজার তদারকির অভাবেই কসাইরা সিন্ডিকেট করে গরু, ছাগলের মাংসের দাম বৃদ্ধি করেছেন বলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করতে থাকেন।
বড় বাজারের মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের কোনো কিছু করার নেই। বেশি দামে গরু কিনে এনেছি। তাই মাংসের দাম বাড়ানো ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই। এখন থেকে এ দামেই গরু, ছাগলের মাংস কিনে খেতে হবে সবাইকে। কথা হলো একই বাজারে সবচেয়ে বড় মাংস ব্যবসায়ী ওহিদুল ইসলামের সাথে। তিনিও সাফ জানিয়ে দেন আমাদের কিছুই করার নেই। বাজারে গরু, ছাগলের তীব্র সঙ্কট রয়েছে। আগে কোনো হাটে ১০০ গরু উঠতো; এখন সেখানে ২০/৩০টি গরুও পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে বেশি দামে গরু কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছি। ছাগলের ক্ষেত্রেও একই গল্প।
অতিরিক্ত টাকা গুনে ভাল মানের মাংস কিনে বাড়ি নিতে পারলে ক্রেতার আফসোস কিছুটা কম হবার কথা। কিন্তু চুয়াডাঙ্গা বড় বাজার থেকে মাংস কিনে সেটি হবার জো নেই। শহরের অন্য এলাকার মাংসের দোকান থেকে যতোটা নিশ্চিন্তে মাংস কেনা যায়; বড় বাজারে সেটি অনেকটা অসম্ভব। ক্রেতাদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ ভোরে পশু জবাই করে তা অন্তত ঘন্টাখানেক পানি দিয়ে ভেজানো হয় ওজন বাড়ানোর জন্য। বড় বাজারের দুই মাংস ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অভিযোগের পাল্লা বেশ ভারি ও ভয়াবহ। এরা নাকি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তোয়াক্কা করে না। সম্প্রতি ভোক্তা অধিকার অধিদফতর ও জেলা বিপণন কর্মকর্তা মাংস ও ভূড়ি পানিতে ভিজিয়ে বিক্রির অপরাধে এক ব্যবসায়ীকে জরিমানা করে উল্টো বিপাকে পড়েছিলেন, মানসম্মান বাঁচাতে শেষ মেষ সেখান থেকে তারা সরে আসেন। এখানে গরু, ছাগলের ভূড়ি বিক্রি করার পদ্ধতি ও দাম নিজেদের মতো বানিয়ে নিয়েছেন কয়েকজন ব্যবসায়ী। পানিতে চুবিয়ে ২ কেজি ভূড়ির ওজন হয়ে যাচ্ছে ৫ কেজি। ক্রেতারা যে বিষয়টি ধরতে পারছেন না তা নয়। তারা বুঝে শুনে বাধ্য হয়েই কিনছেন কৃত্রিমভাবে ওজন বাড়ানো মাংস ও ভূড়ি।
চুয়াডাঙ্গার অন্য হাটবাজারে গরু, ছাগলের মাংস বিক্রির সময় ক্রেতার ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া হয়। মাংসে হাড়ের পরিমাণ ক্রেতাই ঠিক করে দেন। অর্থাৎ যে ধরণের মাংস আপনি নিতে চান সেই মাংসই কেটে আপনার ব্যাগে ভরে দেবেন কসাই । চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারে যেটি কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সিন্ডিকেটের মাংস ব্যবসায়ীদের ইচ্ছামতই ভরবে আপনার ব্যাগ। এখানে মজার একটা তথ্য আছে। মাংস কেটেকুটে সাইজ করার পর দাঁড়িপাল্লার পাশে বসে থাকেন মাংস ব্যবসায়ীর এক বা দুইজন কর্মচারী যার কাজই হচ্ছে হাড্ডিগুড্ডি আর খাওয়ার অযোগ্য অংশ (ছাট মাংস) মাংসে মেশানো অতি সুচতুরভাবে। ক্রেতা একবার বেখেয়াল হলে তো কথাই নেই।
চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারে মাংস ব্যবসায়ী আছেন ১০/১২ জন। কিন্তু ভুঁড়ি বিক্রি করেন হাতেগোণা কয়েকজন। এ বাজারে ভূঁড়ি বিক্রেতাদের দাপট আবার এককাঠি বেশি। গরুর ভূঁড়ি কেটেছেঁটে পরিষ্কার করে পানিতে চুবিয়ে ওজন বাড়িয়ে ২৫০ টাকা ২৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন তারা। এদের কাছেও ক্রেতাদের পছন্দ অপছন্দের কোনো মূল্য নেই। দরদামে মেলার পর বিক্রেতাদের মর্জি অনুযায়ী কিনতে হয় ভূঁড়ি।
বড় বাজারের ছাগলের মাংস নিয়ে বিতর্ক বহু পুরোনো। হাতে গোণা দুএকজন ব্যবসায়ী ছাড়া এখানে নাকি ১নং খাসির মাংস পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এমন অভিযোগ শহরের মাস্টারপাড়ার বাসিন্দা জাকির হোসেনের। চুয়াডাঙ্গা পৌরসভার স্যানিটারি ইন্সপেক্টরের প্রতিনিধি, যিনি নাকি খাসি ও পাটি ছাগলের লিঙ্গ নির্ধারণে সীলমোহর মারার দায়িত্বে থাকেন তিনিও মাংস ব্যবসায়ীদের চাপে অসহায় এমনটিই জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। ছাগল জবাইয়ের পর ট্রেনিংপ্রাপ্ত সহকারী কসাইরা বিশেষ অপারেশনের মাধ্যমে পাটি ছাগলকে খাসি বানিয়ে ক্রেতাদের সামনে ঝুলিয়ে দেন। বাজার মনিটরিঙ কমিটি কর্তৃক বেঁধে দেয়া পাটি ছাগলের মাংসের দাম ৬০০ থেকে ৬২০ টাকা যা খাসির মাংসের ক্ষেত্রে ১০০ টাকা বেশি। বড় বাজারের মাংসের শেডে জবাইয়ের আধা ঘণ্টার ব্যবধানে সব ছাগল হয়ে যায় ১নং খাসি।
চুয়াডাঙ্গা বড় বাজারে আসা ক্রেতাদের অধিকাংশই চাকরিজীবী। সকালে অফিসে আসার আগে হাতে সময় কম থাকায় তড়িঘড়ি করে মাংসের বাজারে হাতের কাছে যা পান তাই বাধ্য হয়ে কিনে বাড়ি ফেরেন। কিন্তু এবার তাঁরাও সোচ্চার। দুর্মূল্যের বাজারে চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম যখন নাগালের বাইরে; তখন মাংসের বাজারে অন্যায্য মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছেন তারা। সেই সাথে বড় বাজারের মাংস ব্যবসায়ীদের পানি দিয়ে মাংস, ভূঁড়ির ওজন বাড়িয়ে বিক্রি করার অপতৎপরতা বন্ধ করা বিষয়ে প্রশাসনের কড়া হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এই ক্রেতারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার অধিদফতর চুয়াডাঙ্গার সহকারী পরিচালক সজল আহমেদ জানান, বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। অন্য বাজার থেকে বড় বাজারে দাম বেশি নিলে বা সিন্ডিকেট হলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশপাশি অবৈধভাবে মাংসে পানি দিয়ে ওজন বাড়ানো বরদাস্ত করা হবে না বলে জানান তিনি। একই কথা বলেছেন জেলা বিপণন কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More