কুষ্টিয়ায় সর্দি-জ্বরে গুরুত্ব না দেয়ায় বাড়ছে মৃত্যুহার : শ্বাসকষ্ট বেশি হলে হাসপাতালে ছুটছেন মানুষ

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় করোনা হাসপাতালে বেশির ভাগ রোগী অধিক শ্বাসকষ্ট নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। ৭ থেকে ১০ দিন আগে এসব মানুষ সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হলেও শুরুতে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। ফলে রোগীর মৃত্যুহার বেড়ে যাচ্ছে। কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয় ও কুষ্টিয়ার করোনা ডেডিকেটেড ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। সিভিল সার্জন কার্যালয় ও করোনা হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, ১২ জুলাই পর্যন্ত জেলায় করোনায় ৩৫০ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে গত ২৮ জুন থেকে ১২ জুলাই পর্যন্ত ১৫ দিনে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ১৪০ করোনা রোগী মারা যান। এ সময়ে জেলায় মারা যান ১৬১ জন। অর্থ্যাৎ মোট মৃত্যুর ৮৭ শতাংশ মারা যান এ হাসপাতালে। করোনা হাসপাতাল বাদে বাকি ২১ জন জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও বাড়িতে মারা যান। করোনা হাসপাতালে ১৫ দিনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৪০ রোগীর মধ্যে ৯০ জনের ভর্তির সময় অক্সিজেন স্যাচুরেশন (মাত্রা) ছিলো ৮০ এর নিচে। সর্বনিম্ন ৩৫ পাওয়া গেছে। এই রোগীদের কোনোভাবেই বাঁচানো সম্ভব হয়নি। রাতের বেলায় মারা গেছেন অন্তত ৪০ রোগী। এ হাসপাতালে প্রতিদিন মারা যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্য খতিয়ে দেখতে ডেথ রিভিউ বোর্ড ও ডেথ অডিট কমিটি রয়েছে। সাত সদস্যের কমিটির সভাপতি হলেন হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট রেজাউল ইসলাম। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চিকিৎসক কাজী নাজমুল হক, মো. আবদুল্লাহ, ইফতেখার হোসেন খান এবং নার্স রতনা খাতুন, জান্নাতুন নাহার ও দিপ্তী তালুকদার। ডেথ রিভিউ বোর্ড ও ডেথ অডিট কমিটির সদস্যরা বলছেন, কুষ্টিয়ায় গ্রামের ঘরে ঘরে করোনা পৌঁছে গেছে। কিন্তু গ্রামের বাসিন্দারা অসচেতন বেশি। যেসব মানুষ ভর্তি হতে আসছেন, তাদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রায় সব রোগীই হাসপাতালে আসার অন্তত ৮ থেকে ৯ দিন আগে জ্বর, ঠান্ডা কাশিতে আক্রান্ত হন। দুই একদিনে এসব সেরে গেলেও তারা নমুনা দিয়ে করোনা পরীক্ষা করান না। স্বাভাবিক জ্বর-ঠান্ডা ভেবে চিকিৎসা নেন। কিন্তু সাত থেকে ৮ট দিনের বেলায় তাদের শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে আসেন। ডেথ রিভিউ বোর্ড ও ডেথ অডিট কমিটির সভাপতি রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে যদি নমুনা নিয়ে চিকিৎসা করাতেন, তাহলে হয়তো সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকত।’ তিনি জানান, গত ১৫ দিনে যারা মারা গেছেন, তাদের ৯৯ শতাংশ রোগীর করোনা টিকা নেয়া ছিলো না। এ ছাড়া অধিকাংশ রোগী কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত ছিলেন।
করোনা হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসক আকরামুজ্জামান মিন্টু বলেন, কয়েক দিন ধরে কুষ্টিয়ায় রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর হার স্থিতি পর্যায়ে আছে। বিধিনিষেধ শিথিল হওয়ার পর আক্রান্তের সংখ্যা বাড়লে ধরে নিতে হবে বিধিনিষেধই ভালো ছিলো। আর তা না হলে বিধিনিষেধ হার কমানোয় কোনো প্রভাব ফেলেনি। তবে এখনো বলার সময় আসেনি, কুষ্টিয়ায় করোনার দাপট কবে নাগাদ কমতে পারে। ৬ জুলাই দুপুরে হাসপাতালের ডেথ রিভিউ বোর্ড ও ডেথ অডিট কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রোগী মৃত্যুর কারণ ও প্রতিরোধ বিষয়ে পর্যালোচনা করে মৃত্যুর হার হ্রাস করার জন্য তিনটি সুপারিশ করা হয়। সুপারিশে উল্লেখ করা হয়, সংকটাপন্ন রোগীদের জন্য আইসিইউ শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি, পৃথক এইচডিইউ ইউনিট স্থাপন, অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানো এবং চিকিৎসক, নার্সসহ তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী বাড়ানোর কথা বলা হয়।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রয়েছে। মঙ্গলবার থেকে বেশকিছু অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স করোনা ওয়ার্ডে দায়িত্ব পালনের জন্য নিয়োজিত হয়েছেন। আইসিইউ বেড ও এইচডিইউ সাপোর্ট দিতে পূর্ণাঙ্গ সরঞ্জাম নেই। এখানে শুধু ১৫০ জায়গায় সেন্ট্রাল অক্সিজেন ও ৩০টি হাই ফ্লো নাজাল ক্যানুলা সাপোর্ট রয়েছে। এক মাস ধরে হাসপাতালে গড়ে প্রতিদিন ২৮০ এর বেশি রোগী ভর্তি থাকেন। এত রোগীর বিপরীতে তিন শিফটে চিকিৎসক যথাক্রমে সকালে চারজন, বিকেলে ও রাতে তিনজন করে দায়িত্ব পালন করেন। একই সময়ে ওয়ার্ডে (এক ওয়ার্ডে অন্তত ৬০ জন রোগী) সকালে ৩ জন, বিকেলে ও রাতে ২ জন করে নার্স দায়িত্ব পালন করেন। আজ থেকে সকালে দুজন, বিকেলে ও রাতে আরও একজন করে চিকিৎসক এবং একজন করে নার্স বাড়ানো হয়েছে। এতে চাপ কিছুটা কমবে। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল মোমেন বলছেন, হাসপাতালে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ সবকিছু ভালো আছে। চিকিৎসক ও নার্স নতুন সংযুক্ত করা হয়েছে। তদারকি আরও বাড়ানো হচ্ছে।

কুষ্টিয়া করোনা হাসপাতালে একদিনে ৯ জনের মৃত্যু
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় ২৪ ঘণ্টায় করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ৯ জন। সোববার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তারা। এদের মধ্যে করোনায় ৮ জন এবং একজন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. এম এ মোমেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০ শয্যাবিশিষ্ট করোনা ইউনিটে মঙ্গলবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ভর্তি রয়েছেন ৩৭৬ জন। এর মধ্যে করোনা নিয়ে এ পর্যন্ত ভর্তি রয়েছেন ২৬১ জন। বাকিরা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রয়েছেন। এদিকে নতুন ৯৯০ নমুনা পরীক্ষা করে ২৯১ জনের দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। জেলায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৫০ জনে। শনাক্ত ২৯১ জনসহ আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৮৭৩ জনে।
জানা গেছে, ২৪ ঘণ্টায় জেলায় নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় করোনা শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ। নতুন করে শনাক্ত হওয়া ২৯১ জনের মধ্যে কুষ্টিয়া সদরের ১১৯ জন, দৌলতপুরের ৫৮ জন, কুমারখালীর ৩১ জন, ভেড়ামারার ৪১ জন, মিরপুরের ৩৮ জন ও খোকসার ৪ জন রয়েছেন। এখন পর্যন্ত জেলায় ৭৩ হাজার ৭০৭ জনের নমুনা পরীক্ষার জন্য নেয়া হয়েছে। নমুনা পরীক্ষার প্রতিবেদন পাওয়া গেছে ৭০ হাজার ৭৯২ জনের। বর্তমানে কুষ্টিয়ায় সক্রিয় করোনা রোগীর সংখ্যা তিন হাজার ৬৯১ জন। তাদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ২৬৯ জন ও হোম আইসোলেশনে আছেন তিন হাজার ৪৩০ জন।
ডা. এম এ মোমেন বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাদের মরদেহ দাফনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার কারণে মানুষ আগের চেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনার নতুন স্ট্রেইন ছড়িয়ে পড়ায় একজনের দ্বারা অনেক লোক আক্রান্ত হতে পারেন। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি মানাতে প্রশাসককে আরও কঠোর হতে হবে। তিনি আরও বলেন, হাসপাতালটিকে ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণার পর থেকে রোগীর চাপ বাড়তেই আছে। প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল কম। এ জন্য চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চিকিৎসাসেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

 

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More