নির্বাচন কমিশনের টানা ছয় দিনের আপিল শুনানি সম্পন্ন

প্রার্থিতা ফিরেছে ২৮০ জনের : পাঁচ জনের মনোনয়ন বাতিল

স্টাফ রিপোর্টার: টানা ছয় দিনের আপিল শুনানি শেষে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন ২৮০ জন। এর আগে সারাদেশের ৩০০ আসনে রিটার্নিং কর্মকর্তার বাছাইয়ের পর বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা ছিল ১৯৮৫ জন। তবে তাদের মধ্যে পাঁচ প্রার্থী বাদ পড়েছেন। ইসিতে আপিল নিষ্পত্তির পর এখন সব মিলিয়ে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ালো ২ হাজার ২৬০। আগামীকাল রোববার প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন। পরদিন ১৮ ডিসেম্বর চূড়ান্ত প্রার্থীদের মধ্যে প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হবে। এর পরই শুরু হবে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার। আপিল শুনানি শেষে গতকাল শুক্রবার ইসি কার্যালয়ের সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেছেন, স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থীকে দলীয় প্রতীক বরাদ্দের সুযোগ নেই। কারণ, বেশ কয়েকটি আসনে নিবন্ধিত দলের একক প্রার্থী মনোনয়ন বাতিল হয়েছে। ওই সব আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দলীয় প্রতীক দেয়া নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছে। আইনগতভাবে এই সুযোগ নেই জানিয়ে ইসি সচিব বলেন, বৈধ মনোনয়নপত্রের বিরুদ্ধে ৩৫টি এবং মনোনয়ন বাতিলের বিরুদ্ধে ৫২৫টি সহ মোট ৫৬০টি আপিল দায়ের হয়েছিল। বাছাইয়ে বাতিল হওয়া ২৮০ জন আপিল শুনানি শেষে প্রার্থিতা ফিরে পেয়েছেন। অন্যদিকে, বৈধতার বিরুদ্ধে ৩৫টি আপিলে পাঁচজনের প্রার্থিতা বাতিল হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ইসিতে বৈধ প্রার্থীর বিরুদ্ধে করা আপিল নিষ্পত্তির পরে চট্টগ্রাম-৯ আসনে আওয়ামী লীগের মহিবুল চৌধুরী নওফেল ও ঝালকাঠি-১ আসনে ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর এবং বরিশাল-৪ আসনের স্বতন্ত্র পঙ্কজ নাথ ও ফরিদপুর-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের প্রার্থিতা বহাল রয়েছে। তবে ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। বিএনপিসহ বিরোধী জোটের বেশ কয়েকটি দল এই নির্বাচনে অংশ না নিলেও আওয়ামী লীগ সারাদেশে ২৯৮ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দেয়। এর মধ্যে বাছাইয়ে সাতজনের মনোনয়ন বাতিল হলেও আপিলে কিশোরগঞ্জ-৩ ও নোয়াখালী-৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী ভোটের মাঠে ফিরেছেন। কিন্তু ফরিদপুর-৩, ময়মনসিংহ-৯ এবং যশোর-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীতরা প্রার্থিতা হারিয়েছেন। প্রার্থিতা ফেরত এবং বৈধ মনোনয়নকে চ্যালেঞ্জ করা আপিল শুনানির শেষ দিনে চলে নানা নাটকীয়তা। এদিন ক্ষমতাসীন দলের ফরিদপুর-৩ আসনের প্রার্থী শামীম হক, বরিশাল-৪ আসনের শাম্মী আহমেদ, বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ এবং ঝালকাঠি-১ আসনের আলোচিত প্রার্থী শাহজাহান ওমরের প্রার্থিতা নিয়ে আপিল শুনানির দিকে নজর ছিলো সবার। শেষ দিনে ৪৭ প্রার্থী নির্বাচন করার অধিকার হারিয়েছেন। তবে কয়েকজন প্রার্থীর মনোনয়নের বৈধতার বিরুদ্ধে আপিল হলেও তা প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণের অভাবে ধোপে টেকেনি। দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগের ‘ভিত্তিহীন’ অভিযোগ এনে ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের বিরুদ্ধে করা একই আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে ইসি। ফলে নির্বাচনে প্রার্থিতা বহাল থাকল এ. কে. আজাদের। এ ছাড়া বরিশাল-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ নাথ, চট্টগ্রাম-৯ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও বর্তমান শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বিএনপি থেকে এসে ঝালকাঠি-১ আসনে নৌকার মনোনয়ন পাওয়া শাহজাহান ওমরসহ ১৭ জনের প্রার্থিতা বহাল রয়েছে। এ ছাড়া আপিল করে ফরিদপুর-৪ আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. আনোয়ার হোসেনসহ ২০ প্রার্থী ভোটের মাঠে ফিরেছেন। গতকাল সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন কমিশন ভবন মিলনায়তনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে ৮৪ জনের আপিল শুনানি হয়। ১০ ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে ছয় দিনব্যাপী আপিলের শুনানি চলে। ফরিদপুর-৩ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত শামীম হক ওরফে হল্যান্ড শামীমের মনোনয়নপত্র বাতিল করেছে ইসি। দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগে তার মনোনয়নপত্র বাতিলের দাবিতে আপিল করেছিলেন ওই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদ। নির্বাচন কমিশন সেই আপিল মঞ্জুর করেন। গত বুধবার ইসিতে শামীমের প্রার্থিতার বৈধতা নিয়ে শুনানি হয়। পরে শুনানি স্থগিত রেখে ইসি শুক্রবার রায়ের দিন নির্ধারণ করে। এর আগে শামীম হক নেদারল্যান্ডসের নাগরিকু এমন অভিযোগ করে তার প্রার্থিতা বাতিলের জন্য এ. কে. আজাদের পক্ষে আইনজীবী মো. গোলাম কিবরিয়া ৮ ডিসেম্বর ইসিতে আপিল আবেদন জমা দেন। আপিল মঞ্জুর হওয়ার পর এ. কে. আজাদের পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজিব উল আলম বলেন, ফরিদপুর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের প্রার্থী শামীম হকের দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ. কে. আজাদের পক্ষ থেকে নির্বাচন কমিশনে করা আপিল মঞ্জুর করা হয়েছে। ফলে শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিল করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের কাছে উভয়পক্ষ থেকে যেসব তথ্যপ্রমাণ পেশ করা হয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে কমিশনের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকার কারণে সংবিধানের ৬৬ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী শামীম হকের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার যোগ্যতা নেই। আরেক আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, ২০২২ সালে যখন শামীম হক বাংলাদেশি পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন, তখন তিনি সেই আবেদনপত্রে ঘোষণা করেন, তিনি নেদারল্যান্ডসের নাগরিক। এই কাগজের ভিত্তিতেই আমরা আমাদের আপিলের আবেদন তৈরি করি। গত বুধবার কমিশন আপিলের যথার্থতা যাচাইয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়। অন্যদিকে, ডাচ দূতাবাসের কথিত বরাত দিয়ে শামীম হকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চার মাস আগেই তিনি নাগরিকত্ব বর্জন করেছেন। এর সমর্থনে কমিশনে শামীম হকের তরফ থেকে একটি কাগজ দাখিল করা হয়। তাতে দেখা যায়, তিনি নাগরিকত্ব পরিত্যাগের ঘোষণাপত্র ৪ ডিসেম্বর ঢাকার ডাচ দূতাবাসে পাঠিয়েছেন। দূতাবাস থেকে তাকে বলা হয়, নাগরিকত্ব বর্জন করতে দূতাবাসের দেয়া একটি ফরম পূরণ করে ১৪ ডিসেম্বর শামীম হককে দূতাবাসে সশরীরে উপস্থিত হতে হবে। নিজের দাখিল করা কাগজপত্রেই শামীম হক ফেঁসে গেছেন বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, শামীম হকের দাখিল করা কাগজের ভিত্তিতে এটা প্রতীয়মান, ১৪ ডিসেম্বরের আগে তিনি তাঁর নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেননি। শামীম হকের কাগজের ওপর ভিত্তি করেই আমরা কমিশনকে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে বলি। এর পর অন্য পক্ষের বক্তব্য নিয়ে কমিশন শামীম হকের প্রার্থিতা বাতিল করেছে। অন্যদিকে, নিজের প্রার্থিতার বিরুদ্ধে আপিল হওয়ায় বসে থাকেননি শামীম হক। তিনিও একই অভিযোগ আনেন এ. কে. আজাদের বিরুদ্ধে। তাঁর অভিযোগ এ. কে. আজাদ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তবে গতকাল আপিলের শুনানির সময় তার আইনজীবীরা এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তারা কমিশনের কাছে আরও কিছুটা সময় চাইলেও তা নামঞ্জুর করা হয়। ফলে মাঠেই মারা যায় হল্যান্ড শামীমের আপিল। শামীম হকের আপিল বাতিল হওয়ার বিষয়ে এ. কে. আজাদের আইনজীবী মোস্তাফিজুর রহমান খান বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ. কে. আজাদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন। এই আপিলের শুনানির সময় আপিলকারীর আইনজীবীর কাছে ইসি জানতে চায়, তাদের আপিলের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য আছে কিনা? শামীম হকের আইজীবীরা তা দিতে অসমর্থ হন। তারা কমিশনকে এ বিষয়ে তদন্তের অনুরোধ জানান। তখন সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকায় ইসি তাদের আপিল খারিজ করে দেন। অর্থাৎ এ. কে. আজাদের প্রার্থিতা বহাল থাকলো। বরিশাল-৪ আসনে শাম্মী আহমেদের প্রার্থিতা বাতিল করেছে ইসি। একই আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী পঙ্কজ নাথের প্রার্থিতা বহাল রেখেছে কমিশন। দ্বৈত নাগরিকত্ব (অস্ট্রেলিয়া) থাকার অভিযোগে শাম্মী আহমেদের প্রার্থিতা বাতিল হয়। নির্বাচন কমিশনে দুটি আপিল আবেদন করেছিলেন শাম্মী। এর একটি হলো রিটার্নিং কর্মকর্তার বাতিল করা মনোনয়নের বৈধতা ফিরে পাওয়া, অন্যটি পঙ্কজ নাথের মনোনয়নপত্র গ্রহণের বিরুদ্ধে। পঙ্কজ হলফনামায় তথ্য গোপন করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছিলেন শাম্মী। নির্বাচনের মাঠে টিকতে পারলেন না বরিশাল-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী সাদিক আবদুল্লাহ। দ্বৈত নাগরিকত্বের অভিযোগে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল চেয়ে আপিল করেন একই আসনের আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী জাহিদ ফারুক। এ আবেদন মঞ্জুর হওয়ায় সাদিক আবদুল্লাহর প্রার্থিতা বাতিল হলো। অন্যদিকে, জাহিদ ফারুক মামলার বিষয়ে তথ্য গোপন করেছেন অভিযোগ তুলে তার প্রার্থিতা বাতিলের আপিল করেছিলেন সাদিক আবদুল্লাহ। সেই আপিল নামঞ্জুর করা হয়। ফলে জাহিদ ফারুকের প্রার্থিতা বহাল থাকছে।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More