সিজারিয়ান কমাতে জোর উদ্যোগ জরুরি

সম্পাদকীয়

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে প্রতি একশ গর্ভবতী নারীর মধ্যে ১০ থেকে ১৫ জন মা ও গর্ভস্থ সন্তান ঝুঁকিতে থাকে। সেখানে সর্বশেষ জনমিতি জরিপে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে সন্তান প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার (সিজারিয়ান) হচ্ছে প্রতি ১০০ জনে ৪৫ জনের। এর মধ্যে ৮৪ ভাগ অস্ত্রোপচার আবার হচ্ছে বেসরকারি হাসপাতালে। অথচ ২০০৪ সালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম হতো মাত্র ৪ শতাংশ শিশু। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যাবিষয়ক চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে গত শুক্রবার বাংলাদেশে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দেয়ার উচ্চ হারের বিষয়টি আলোচিত হয়। ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসি বেগমের মতে, শিশু জন্মে অস্ত্রোপচার সুনামির মতো ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। ওই সম্মেলনে আলোচকেরা দাবি করেছেন, অস্ত্রোপচারের কারণে মাতৃমৃত্যু কমে, এর কোনো প্রমাণ নেই। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে কেন এই অহেতুক অস্ত্রোপচার? মা ও শিশুর জীবন রক্ষার প্রয়োজনে যে অস্ত্রোপচার, তার বাইরে ঢালাওভাবে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের পেছনের মূল কারণটি বাণিজ্যিক। বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারের হার এই অপ্রিয় সত্যকেই নিশ্চিত করছে। শহর থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়ে বহু হাসপাতাল ও ক্লিনিক টিকেই আছে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারের ওপর। এসব হাসপাতাল ও ক্লিনিকের কাজ হলো হবু মা ও তার পরিবারের সদস্যদের মনে ভয় ঢুকিয়ে স্বাভাবিক প্রসবে নিরুৎসাহিত করা। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর উদ্দেশ্য ব্যবসা। যেখানে স্বাভাবিক প্রসবে খরচ নামমাত্র, সেখানে অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম দিতে হাজার হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। অনেক সময় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর লোভের শিকার হতে হচ্ছে প্রসূতি ও নবজাতকদের। নামসর্বস্ব হাসপাতাল ও ক্লিনিক খুলে অস্ত্রোপচার করতে গিয়ে মা ও শিশুর জীবন গেছে, এমন উদাহরণ কম নয়। সন্তান জন্মদানে অস্ত্রোপচারের এই অস্বাভাবিক হারের পেছনে আরেকটি উদ্বেগজনক দিক হচ্ছে জনগণের মধ্যে সচেতনতার অভাব। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজে এবং শহুরে মায়েদের অনেকেই স্বাভাবিক প্রসবকে ঝামেলা মনে করেন। শুধু বাণিজ্যিক বিবেচনায় অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান জন্মদানের যে ‘সুনামি’ ঘটে চলেছে, তা দেশের স্বাস্থ্য খাতের চরম অব্যবস্থাপনা ও জবাবদিহিহীন পরিস্থিতিকেই তুলে ধরে। জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হলে কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অস্ত্রোপচার হচ্ছে, তা সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত নজরদারি করতে হবে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেতে হবে। যথাযথ ব্যাখ্যা না পাওয়া গেলে হাসপাতাল ও ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল করার মতো কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি হবু মা ও তার পরিবারের লোকজনকে সচেতন করতে দরকারি প্রচার চালাতে হবে। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে আর্থিক ক্ষতির পাশাপাশি মায়ের রক্তক্ষরণ বেশি হতে পারে, শিশুও শ্বাসকষ্ট ও পরে অ্যাজমা ও স্থূলতায় আক্রান্ত হতে পারে এসব নিয়ে জোরদার প্রচার দরকার। অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা কতোটা কার্যকর, তার উদাহরণ চীন। ২০১০ সালে চীনে অস্ত্রোপচারে সন্তান প্রসবের হার ছিলো আমাদের মতোই। প্রতি ১০০ জনে ৪৬ জন। সাত বছরের মাথায় এই হার ৩৪-এ নামে, এই ধারা অব্যাহত আছে। চীন কী করে স্বাভাবিক প্রসব বাড়ালো, তা নিয়ে চীনের ন্যাশনাল স্ট্যাটিসটিকস অফিস, পিকিং ইউনিভার্সিটি, হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল এবং নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ওয়াগনার স্কুল অব পাবলিক স্কুল গবেষণা চালায়।

ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, মাতৃস্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ, মধ্যবিত্তের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো ও অস্ত্রোপচারে কেউ উদ্বুদ্ধ করলে শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করে চীন অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমিয়েছে। এই দৃষ্টান্ত ও অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিলে সন্তান জন্মদানে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার কমিয়ে আনা আমাদের দেশেও কঠিন হবে না।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More