২১ জুন : কবি নির্মলেন্দুগুণের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলী

‘তোমার চোখ এতো লাল কেন’ – দেশভক্তি নিলামের কবিতার জনক কবি নির্মলেন্দু গুণের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জালী…
;;;;;;;;;;;;নাসিমা হক মুক্তা
প্রেম বিষয়টি বুঝে না এমন মানুষ পৃথিবীতে কম আছে। প্রেম হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের অলংকার। সেই প্রেম যদি সাহিত্যের সাথে মিশে যায় তাহলে সাহিত্যের প্রতিটি শব্দ ও মার্জিনের কারুকাজগুলো এতোই দৃষ্টিনন্দন হয় যে পাঠক প্রার্থনারত হয়ে পড়ে। বইয়ের ভাঁজে ভাঁজে সাজানো প্রতি মনোভাব যেন স্বয়ং দেবতার উপস্থিতি টের পাওয়ার সমান। সে রকম কবিকে গোছানো শব্দের অলংকার শাস্ত্রের পন্ডিত বললেও কম হবে। আজ আমি বাংলাদেশের সেই রকম একজন কবির কথা বলবো যিনি নারী- প্রেম ও নারী-রূপের গন্ধকে নাকের ডগায় নিয়ে গভীর অনুভূতি ও অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ধ্রুপদী প্রেম ও দেহরূপের উচ্ছ্বসিত জৌলুস কে বর্ণনা করেছেন ভারী অনুরাগ দিয়ে। তাঁর কবিতা দুর্মর দেহজ কাম, দুর্বোধ্য মনস্তাাত্ত্বিক ও বাস্তবতা নির্ভর। নারী জগতের পার্থিব প্রেম,পুরুষের লোলুপতা ও গভীর ব্যথাবোধের কথাগুলো প্রকাশ করেছেন অনুভূতির ভিন্ন আঙ্গিকের উন্মাতাল বৈশিষ্ট্য দিয়ে।সর্বোপুরি তিনি একজন নারী প্রেমবাদ্ধব কবি, বৈষম্য ও শ্রেণি বিভাজন সংগ্রাম ও স্বৈরাচার বিরোধিতার বিষয়গুলো আধুনিক শব্দ ও সময়োপযোগীর বহিঃপ্রকাশে তাঁর লেখার মূল বিষয় ছিল।
তিনি হচ্ছেন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান আধুনিক ও প্রেমের কবি। তবে তাঁর কবিতার বইগুলো পাঠ করলে বুঝা যায় তিনি হচ্ছেন একজন প্রকৃত নারী বা নারীর পুরোহিত পুরুষ কবি। তিনি নারীর সৌখিনতা ও নমনীয় সত্তাকে নির্লজ্জতার বেড়াজাল থেকে বের হয়ে নারী সৃষ্টির রহস্যময়তা এবং পুরুষের ধ্যানমগ্নতাকে কাব্যিক ব্যঞ্জনায় লোভনীয় শব্দের ডালপালা দিয়ে উপস্থাপন করেছেন। উনার এমন রসপরিণতি ভাবনাগুলো নারীর বিষয়বস্তু দিয়ে তাঁর কাব্য মনীষাকে আরও অভিনবত্বের যাদু সৃষ্টি করে পুরুষ প্রেমিকদের ঘোরের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। তিনি কে ? এমন উত্তরে যার নাম বের হয়ে আসেন –
তিনি হচ্ছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণা জেলার বারহাট্টা থানার কাশবন এলাকায় তিনি ১৯৪৫ সালের ২১ জুন (আষাঢ় ৭, ১৩৫২ বঙ্গাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর বাবার নাম সুখেন্দু প্রকাশ চৌধুরী ( একজন চিত্রশিল্পী) ও মায়ের নাম বিনাপানি। কবির পারিবারিক নাম হচ্ছে নির্মলেন্দু গুণ চৌধুরী। কবিতা ও দেশপ্রেমের এই কবি একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন এবং তাঁর পাশাপাশি গদ্য ও ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন অসংখ্য। তবে সুখেন্দু প্রকাশ চৌধুরী আগ্রহ ছিলেন যেন তাঁর ছেলে একজন চিত্রশিল্পী হোক। কারণ তাঁর বাবা কলকাতার আর্ট স্কুলের পুরোপুরি পাঠ করতে না পারার একটি জখম বুকে লালন করতেন সবসময় তাই তিনি মনে প্রাণে চাইতেন তার কোনো না কোনো সন্তান চিত্রশিল্পী হোক। হয়ত তাঁর পিতার এই গুণটির ইচ্ছের কথা হয়ত মনে-মনে ধারণ করে সাহিত্য জগতের সাথে সাথে চিত্রশিল্পীর কাজটিও সম্পন্ন করতেন সুচারুভাবে। খুব ছোট বয়সে ( চার বছর) তাঁর মাকে হারিয়ে পৃথিবীর সমস্ত মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হলেও পরে তাঁর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে ঐ মায়ের হাতে তাঁর প্রথম জীবনের শিক্ষার হাতেখড়ি শুরু হয়। বারহাট্টা করোনেশন কৃষ্ণপ্রসাদ ইন্সটিটিউটে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে ঐ স্কুল থেকে ১৯৬২ সালে দুই বিষয়ে লেটারমার্কসহ মেট্রিক পাস করেন প্রথমে বিভাগে। ঐ স্কুল থেকে তখন মাত্র কবি নির্মলেন্দু গুণসহ আরও দুজন প্রথম বিভাগে পাস করেন। তবে তিনি অষ্টম শ্রেণীতে থাকাকালীন নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ” উত্তর আকাশ ” পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল তাঁর কবিতা প্রথম কাব্য ” নতুন কান্ডারী। সেই থেকে কবির লেখালিখির প্রতিভা পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়।মেট্রিক পাস করার পর কবি চলে আসেন আইএসসি পড়তে ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। প্রথম বিভাগে ভালো পাস করার সৌজন্যে রেসিডেন্সিয়াল স্কলারশিপ নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ সেখান থেকে নেত্রকোণায় ফিরে গেলে বাবার অনুরোধে নেত্রকোণা কলেজে ভর্তি হোন। ১৯৬৪ সালের নেত্রকোণা কলেজে থেকে আই এস সি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি ছিলেন একমাত্র নেত্রকোণা কলেজের মাথা উঁচু করিয়েছিলেন।
তখনো তিনি ফাস্ট ক্লাস স্কলারশিপ বাবত মাসে ৪৫ টাকা বেড়ে বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা করে পাচ্ছেন।তাঁর বাবা প্রবল আগ্রহ ছিল ছেলে যেন ডাক্তারী পড়ে কিন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলেন ফার্মেসী বিভাগে।ঐ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন হঠাৎ ঐ সময়ে ঢাকায় বিরাট গন্ডগোল লেগে হিন্দু,- মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয়। পরে হতাশাগ্রস্থ হয়ে ১৯৬৯ সালে ফিরে এসে আনন্দ মোহন কলেজ থেকে বি.এ পাশ করেন। সেই সার্টিফিকেট এযাবতকালে আর তুলেননি। আবার ১৯৬৫ সালে বুয়েটে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল।
যদিও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার আফসোস নিয়ে প্রায় সময় ঢাকা আসার যাওয়া করতেন। সে সুবাদে বিভিন্ন লেখক ও কবির সাথে তাঁর সম্পর্ক গড়ে উঠে। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী “সাপ্তাহিক জনতা ” ঢাকার একটি পত্রিকা থেকে তাঁর কবিতা ” কোন এক সংগ্রামীর দৃষ্টিতে ” ছাপানো হয়। এটি ছিল তাঁর ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম কবিতা। এরপর ” সূর্য ফসল” নামেই নিজের সম্পাদনা সংকলন করেন। ঐ সংকলনের প্রতিটি কবিতা শোষক ও শাসকের নিপীড়নে বিরুদ্ধে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর হাতিয়ার ছিলো। এই সংকলন নিয়ে বেশ আশাবাদী ছিলেন কবি সিকান্দর আবু জাফর। এরপর থেকে তাঁর লেখালিখির পথ যতটা সহজ হয় ততটা কঠিনও হয়ে যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের চার মাস আগে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ” প্রেমাংশু রক্ত চাই ” প্রকাশিত হয়।তরুণ কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ১৯৭০ সালে বিনামূল্যে ” খান ব্রাদার্স ” প্রকাশনী থেকে ১২৫০ কপি বই আলেকজান্দ্রার স্টিম মেশিন প্রেস থেকে ছাপানো হয়। ঐ প্রকাশনী থেকে বনলতা সেন কবিতার জনক জীবনানন্দ দাশেরও কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হযেছিল। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নামকরণে কবি সম্ভাব্য নাম ছিল – হুলিয়া, দাঁড়ানো মহিষ, আগুন নিয়ে বসে আছি। এই নামগুলোর দ্বিধা থেকে তাঁর জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সহযোগিতা করলেও পরে আরেক বন্ধু পূরবী বসু দুজনের সম্মতিতে ” প্রেমাংশুর রক্ত চাই ” নামকরণ করেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের ১৯৬৯ সালে বাংলাদেশ বেতারে প্রথম কবিতাপাঠ করার সুযোগ হলে সেখানে তিনি দুটি কবিতা: ১:মিউনিসিপ্যালিটি ( প্রেমাংশুর রক্ত চাই) ২: ফুলদানি ( না প্রেমিক না বিপ্লবী) পাঠ করেছিলেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণের জীবন ছিল অনেকটা ভবঘুরের। যেখানে পায় সেখানেই খেত আর ঘুমাত। ঢাকা গেলে ফুটপাতে রাত কাটাত। মাঝে মাঝে বন্ধুদের মেসে ( নাট্যজন মামুনুর রশিদ) সাথে আড্ডা দিত। এভাবে সময় পার করতে করতে হঠাৎ ” দ্য পিপল” পত্রিকায় চাকরি হয়।তখন তাঁর বয়স ছিল ২৬ বছর।বেতন পেত ২৫০ টাকা। এরপর নিজে একটি মেস( টিনশেড) ভাড়া নেয়। বোহেমিয়ান জীবনের কিছুটা গতি হলো। মেসের জীবন খুব উপভোগ করছিল কবিতা ও আড্ডায়। হঠাৎ ১৯৭০ সালের অতীতের ছন্নছাড়া জীবন স্মরণ করে ” মানুষ ” নামের কবিতাটি লিখেন। অসংখ্যক বন্ধুজনকে তাঁর লেখা কবিতা উৎর্সগ করলেও অগ্রজ কবি শহীদ কাদরী নিজেই একটি কবিতা উৎসর্গ করতে বললে ” যুদ্ধ”নামক ছোট কবিতাটি উৎসর্গ করেন।
কবি নির্মলেন্দু গুণ গুটি কয়েক বছর পরে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় নিয়ে অনার্স ভর্তি হয়েছিলেন। সেখানে তিনি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সহপাঠী হিসেবে পান। দেশ স্বাধীনতা অর্জনের আগে থেকে তিনি সমাজতন্ত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।জাতিরজনক বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিষয়গুলো কবিকে খুব টানত এবং বঙ্গবন্ধুর প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়েন। তৎকালীন ৬৬”এর দফা আন্দোলন শুরু হলে তখন বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে একটি কবিতা শিরোনাম ” প্রচ্ছদের জন্য ” লিখেন। তখন বঙ্গবন্ধু জেলখানায় বন্দী অবস্থায় কবিতাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়েছিলেন। সেটা ১৯৬৭ সালে ১২ নভেম্বর ‘ সংবাদ ” পত্রিকায় ছাপালে সেই সুবাদে বঙ্গবন্ধুর নজরে পড়ে। কবির ভাষ্য মতে ” সালটি ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর”।লতিফ সিদ্দিকী বঙ্গবন্ধুকে কবিতাটি পড়তে দিয়েছিলেন এবং রনেশদাশগুপ্ত অর্থসহ পাঠ করে শোনালে উচ্ছসিত কন্ঠে হেসে বলেন – ” দেখেন তো আপনার কবি আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে, কী বলতে চাচ্ছে কবিতার মাধ্যমে। “আপনারা আমাকে চিনতে পারেন নাই, কবি আমাকে চিনতে পেরেছে। পরে ঐ কবিতার শিরোনাম পরিবর্তন করে ” স্বদেশের মুখ শেফালি পাতায় ” নাম দেন। ১৯৬৮ সালে ২৯ জুলাই হোটেল পূর্বাণিতে তরুণ কবিদের আসর বসলে সেখানে কবি নির্মলেন্দু গুণও কবিতা পাঠের সুযোগ পান। এই আসরটি বিভিন্ন মিড়িয়া টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের প্রচার পান।ঐ সময়ে থেকে তাঁর লেখা সংবাদ, জোনাকি, আজাদ পাক জমহুরিয়াত প্রভূতি পত্রিকায় নিয়মিত ছাপানো হত।
ষাট দশকের বাংলাদেশের সাহিত্যে ও সংস্কৃতির ওপর যে অকাল ও জন্মান্ধ প্রবণতা বিরাজ করত সেখানে সেই সময়ের কবিতার মান ও কারুশিল্প বিচারে একজন লেখককে তার উত্তরাধিকার মেনে নিয়ে কাব্য সৃজন করা সেক্ষেত্রে অনেকের মাঝে কবি নির্মলেন্দু গুণ সেক্ষেত্রে বিশেষ কাব্য গঠনশৈলীর গুণধারীর অসাধারণ একজন কবি ছিলেন। ষাট দশকের শেষ ও দত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কবি গুণের পাঠকপ্রিয়তা তার প্রজন্মের মধ্যে সেরা ও ঈর্ষানীয় ছিল। যার কবিতায় প্রেম, প্রবল আবেগ, সমাজের বাস্তবতা ও রাজনৈতিক বিপ্লবে দায়বদ্ধতা সমান্তরালের অনুভূতি ফুটে উঠত।সেক্ষত্রে স্বীকারোক্তিমূলক ” হুলিয়া ” কবিতাটি কবি নির্মলেন্দু গুণকে বিস্তৃত পরিধি এনে দেয় বাংলাদেশের সাহিত্য অঙ্গনে। সেই সময়ে তরুণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরে ” হুলিয়া ” কবিতাটি পাঠ করে কবি তাঁর কাব্য জাত চিনিয়ে দিলেন।বাংলার সমস্ত কলম শক্তিধর লেখকেরা তাঁর কবিতার প্রশংসার জোয়ারে ভাসিয়ে দিলেন।”তৃতীয় মত ” শিরোনাম ” হুলিয়া ” কবিতা নিয়ে কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী একটি কলাম লিখেন। এই কলামটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু মুজিবুর চোখ পড়লে তিনি সাথে সাথে কবি নির্মলেন্দু গুণকে দেখার ইচ্ছে পোষণ। কমালিষ্ট আবদুল গাফফার থেকে জানতে চাইলো যে – এই কবি কোথায় থাকে জানেন ? আবদুল গাফফার উত্তর দিলো জানি না তখন ” দি পিপল” পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান বললো এই কবি আমার কাগজে চাকরি করে। তখন ( শেখ মুজিব) বললো – এই কবিকে একদিন নিয়ে আসেন। তারপর আবিদুর রহমান কবি কে খবরটা দিলে কবি নির্মলেন্দু গুণ খুব খুশি ও গর্ববোধ করেছিলেন। এরপরে দিন শেখ মুজিবের সাথে দেখা করতে যেতে চাইলে আর যাওয়া হয়ে উঠেনি।২৫ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ীতে গেলে সেদিন তিনি পরিবারের ঘনিষ্ঠজনদের সাথে আলোচনা ব্যস্ত থাকলে দীর্ঘঘন্টা অপেক্ষার শেষে দেখা করতে না পারার দুঃখ নিয়ে ফিরে আসেন আজিমপুরে।সেদিন রাত দশটার মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী আর্মিরা ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট চালালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতে ও চালায়। তখন ইকবাল হলে থাকতেন বাংলাদেশের আরেক কবি হেলাল হাফিজ তবে সেদিন কবি তাঁর না হলে থাকাতে প্রাণে বেঁচে যান। এই ঘটনার পর কবি নির্মলেন্দু আজিমপুর থেকে কবি হেলাল হাফিজ কেমন আছেন এটা জানতে ইকবাল হলে যান।সেখানে গিয়ে দেখেন চারিদিকে,আগুনের স্তুপের মাঝে পোড়া লাশ আর লাশ। তখন মনের মধ্যে অজানা একটি ভয় চেপে বসে কারণ হেলাল হাফিজ ঐ হলে থাকতেন। তারপর সামনে যেতে যেতে জহুরুল হকের গেটে গেলে কবিহেলাল হাফিজের সাথে দেখা হলে তাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। তারপর দুজনের মতে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে চলে যান কেরানীগঞ্জে। পরে অবশ্যই তিনি কলকাতায় চলে যান।
তিনি কলকাতার আকাশবাণী ভবনের ” বেতার জগত” সম্পাদক ডাঃ গাঙ্গুলির সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে কবিতাকে ধারণ জীবন কাটাতো ওখানে। কবিতা যে প্রতিবাদের নিরট বুলেট সেটা দেখিয়েছেন তাঁর লেখায় কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবি এই সময়ের অন্তমুখী ভাব ও মানব মনের চেতনা জগতের সমস্ত প্রতিক্রিয়াকে যৌক্তিক, বৌদ্ধিক কল্পনা ও সৃজনীশক্তি বিস্তারে পাখা ছড়িয়েছেন। রোমান্টিক চেতনাঋদ্ধতা ছাড়িয়ে গিয়ে মানবিক চেতনা যে বিরাট একটি অংশে কবি সাহিত্যিকের দায়িত্বের বিষয়বস্তু তাও শুধু কবি গুণের মধ্যেই বেশির ভাগ পরিলক্ষ করা যায়। কবি বিশ্বাস করেন যে সৎ সাহস, সততা, সৃজনশীল মনোভাব এই যার মধ্যে বিস্তার করে সে কল্পনা যানের সক্রিয় উপস্থিতিতে সেটিকে কবিতার বাস্তবতার রূপ দেওয়া একদম সহজ বিষয়। তিনি করেছেন ও তাই।যেখানে যা মনে এসেছে তা প্রকাশ করতে সামান্যও দ্বিধা করেননি। সেটা এতো সহজ বিষয়ও নয়। যেসব উনি পয়দা করলেন সেগুলো পাঠ করলে আবেগ ও ছন্দগুলো পরস্পর এমনভাবে ক্লাইম্যাক্স তৈরি করেছেন যে তাঁর কবিতাগুলো পড়তে আনন্দ ও রস দুটো উপভোগ করা যায়। বাংলা সাহিত্যের একদল সুফি ও ব্যঙ্গাত্বক মানুষ তাঁর কবিতা যৌনতাও বলেছেন। এসব যুক্তি পক্ষে অনেকেই গায়ে ফোসকা পড়ার মতোন ব্যঙ্গ করেন। তবে কবি এসব গায়ে মাখেন না। তাঁর স্বচ্ছ কলম যখন যেটা ধরেছেন, তখন সেটা ধরে তুলেছেন পাঠক সমাজে। কবির ভাষ্য মতে ” কবিতা আমার নেশা- পেশা, প্রতিশোধ গ্রহণের হিরণ্ময় হাতিয়ার “। কবি তাঁর লেখালিখি জগতে বিভিন্ন চাকুরী করেছেন, দি পিপল, কন্ঠস্বর, নাগরিক, জোনাকি, পরিক্রম, আল মাহমুদ সম্পাদিত ” গণকন্ঠ”, সহকারী সম্পাদক হিসবে দৈনিক বাংলা বাণী ও সংবাদ ইত্যাদি। কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রাপ্তির খাতায় ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি পুরষ্কার, ২০০১ সালে একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরষ্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কবি আহসান হাবীব সাহিত্য পুরস্কার পান।

দেশপ্রেমের দায়ভার থেকে কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে তিনিই প্রথম উৎসর্গ করেন কবিতা লিখেন। এর আগে বাংলাদেশের আর কোনো কবি জাতির পিতাকে নিয়ে কেউ কবিতা লিখেননি।কবি নির্মলেন্দু গুণ এখন বয়সের ভারে অনেকটা দুর্বল হয়ে কবিতাকে পুঁজি করে দিন কাটাচ্ছেন। রীতিমতো লিখছেন তাও আবার দেশের নিদানকালে নিজেকে প্রমাণ করেছেন যৌবন উদ্দীপ্ত মানুষ হিসেবে তিনি কতটুকু দেশপ্রেমিক ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধাশীল।যেমন – বর্তমানের নাজুক, অসহায়, দুস্ত, দরিদ্র ও
করোনাক্রান্ত দুর্গত মানুষদের জন্য তাঁর লেখা ” তোমার চোখ এতো লাল কেন ” কবিতাটি নিলামে তুললে এটা বিক্রি হয় ৯৯ হাজার ৯৯৯ টাকায়। এটি ক্রয় করেন এক মানবিক মানুষ যার নাম সায়মা মাশরুর। আগামী ২১ জুন কবির ৭৬ তম জন্মদিন। বাংলা সাহিত্যের নিজস্ব এক গুণাবলির মানবিক ও দেশদরদীর কাব্য ভুবনের এই কবির প্রতি বিনম্র ও ভালোবাসা জ্ঞাপন করছি। আমাদের মাঝে আজীবন সবুজ কাব্যিক সত্তার ঢাল ছড়িয়েছে সুখী ও সুন্দর জীবন উপভোগ করুক।

কবি : নাসিমা হক মুক্তা

Comments (0)
Add Comment