নদী পাড়ে প্রিয়জনদের লাশের জন্য নির্ঘুম রাত : নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৫১

পঞ্চগড়ের করতোয়ায় নৌকাডুবি : দ্বিতীয় দিনে ২৬ লাশ উদ্ধার হলেও এখনো নিখোঁজ বহু 

স্টাফ রিপোর্টার: পানি থেকে এখনো তোলা হচ্ছে নিথর দেহ। মর্মান্তিক এমন ঘটনা এর আগে পঞ্চগড় জেলাবাসী কোনোদিন দেখেনি। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে কেউ-ই একসঙ্গে এত মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না। মৃতদের বাড়িতে আহাজারি। কেউ কেউ প্রিয়জনদের হারিয়ে নির্বাক। কেউ কাউকে সান্ত¡না দিতে পারছে না। নদীর পাড়ে প্রিয়জনদের লাশের জন্য অনেকের কাটছে নির্ঘুম রাত। নিখোঁজদের সন্ধানে নদী তীরে ভিড় জমাচ্ছেন স্বজনরা। একটি লাশ উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন সবাই। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে এখনো উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল। নিখোঁজ স্বজনদের অনেকেই ভিড় করছেন মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদের তথ্য কেন্দ্রে। নতুন করে কোনো লাশ উদ্ধার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তথ্যকেন্দ্রের বাইরে বোর্ডে ছবি লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। পরিচয় নিশ্চিতের পর সেখানে নাম ও ঠিকানা লেখা হচ্ছে।

করতোয়ায় কতো জল তা যেমন মাপা যায় না, তেমন স্বজনহারা শত শত মানুষের অশ্রুও পরিমাপ অযোগ্য। গতকাল সোমবার সারাদিন পঞ্চগড়ে করতোয়া নদীর তীরে দেখা গেছে বিমর্ষ মানুষের ভিড়। তারা নৌকাডুবিতে নিখোঁজ স্বজনের সন্ধানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কেউ কেউ পেয়েছেন লাশ, কেউ পাননি। এখনও স্বজনদের বিলাপে ভারী এই নদী তীর। নৌকাডুবির ঘটনায় সোমবার সারাদিনই বেড়েছে মৃতের সংখ্যা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একে একে ২৬ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এর আগে রোববার দুর্ঘটনার পর ২৬ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়। সোমবার রাত ৯টা নাগাদ মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫১ জনে দাঁড়ালো। তাদের মধ্যে ২৩ জন নারী এবং ১৩ জন শিশু রয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) খোলা তথ্যকেন্দ্র থেকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন পঞ্চগড়ের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) ও তদন্ত কমিটির প্রধান দীপঙ্কর রায়। এখনও ৩৫ জনের মতো নিখোঁজ বলে প্রশাসন জানিয়েছে। তাদের সন্ধানে উদ্ধার তৎপরতা চলছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের রংপুর, রাজশাহী ও কুড়িগ্রামের তিনটি ডুবুরি দল উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার করতোয়া নদীতে রোববার এই মর্মান্তিক নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। এরপর সময় যত গড়াচ্ছে নিখোঁজদের জীবিত ফিরে আসার আশা কমছে। সোমবার সূর্য ওঠার পর থেকেই ঘটনাস্থল করতোয়ার আউলিয়া ঘাট ও এর আশপাশে নিজ উদ্যোগে নিখোঁজদের খোঁজ শুরু করেন স্বজনেরা। স্বজনের খোঁজে কেউ কেউ পাগলের মতো এদিক-ওদিক ছোটেন। কেউ বোনের জন্য গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদেন, কেউ ভাইয়ের লাশের সামনে মাতম করেন। করতোয়া পাড়ে স্বজন হারানোর এই বিলাপে চোখের জল ধরে রাখতে পারছেন না কেউ।

নিখোঁজদের স্বজনেরা সোমবার সকাল থেকে নদীর পাড়ে প্রিয় মানুষগুলোর অপেক্ষায় বসেছিলেন। লাশ উদ্ধারের খবর মাড়েয়া আউলিয়ার ঘাট ও ইউপি কার্যালয়ে খোলা তথ্যকেন্দ্রে আসার পর মরদেহের ছবিসহ বাইরের নোটিশ বোর্ডে টাঙিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। সেখানে স্থানীয় লোকজন স্বজনদের লাশ শনাক্ত করতে ভিড় করছিলেন।

নৌকাডুবিতে দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর হাতিডোবা গ্রামের বীরেন চন্দ্র রায়ের দুই পুত্রবধূ ও দুই নাতি মারা গেছেন। তাদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। মাড়েয়া ইউনিয়নের বটতলি গ্রামের প্রভাত বালা (৬৬) কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলেন, ছেলে কিশোর (৪৬), তার স্ত্রী কণিকা রানী (৪২) ও ভাইয়ের মেয়ে শিশু পারুল বোদেশ্বরি যাচ্ছিলো। কিন্তু নৌকায় লোক বেশি থাকায় আমি সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। তীরে যেতে যেতে ডুবে যায় নৌকা। একশ’র বেশি লোক সবাই নদীতে ভেসে যায়। অনেক খুঁজে গতকাল কণিকার নিথর দেহ পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, ছেলেকে পেলে আমি কি জবাব দেবো, ভেবে পাচ্ছি না। তবুও তিনি ছেলেকে জীবিত উদ্ধার চান। বলেন, ওর মুখ দেখে দুঃখটা কিছুটা হলেও লুকিয়ে রাখতে পারবো। মাড়েয়া বটতলি এলাকার ধীরেন বাবুর দুই প্রতিবেশীসহ ৭জন নিকটাত্মীয় এখনো নিখোঁজ। নৌকাডুবির পর থেকে তিনি নদীর পাড়ে অপেক্ষা করছেন। বলেন, বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজায় যোগ দিতে আমার ভাতিজা, ভাতিজার বউ, ভাতিজার শ্বশুর, শ্যালিকা এবং আমার ভাতিজি নৌকায় ওঠে দুর্ঘটনায় পড়েন। এখন পর্যন্ত কারও খোঁজ পাইনি। তাদের লাশের অপেক্ষা করছি। খগেন্দ্র নাথ নামের এক ব্যক্তি বলেন, আসন্ন দুর্গাপূজা আমাদের শেষ হয়ে গেলো। আশেপাশের প্রায় বাড়িতে শুধু কান্না আর কান্না। কাকে থামাবো, কাকে সান্ত¡না দিবো? দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডোবা ছত্রশিকারপুর গ্রামের রবিন চন্দ্রের বাড়িতে মাতম ক্ষণে ক্ষণে বাড়ছে। প্রতিবেশী অলকা রানী জানান, কীভাবে থামবে ওরা। নৌকাডুবিতে রবীনের স্ত্রী তার একমাত্র ছেলে বিষ্ণু (৩) সহ যাচ্ছিলেন। ছেলেকে কোনোভাবে উদ্ধার করতে পারলেও হাসপাতালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন। একই অঘটনে হারিয়েছেন ছোট ভাই কার্তিক রায়ের স্ত্রী লক্ষ্মী রানী (২৬) ও বড় ভাই বাবুল রায়ের ছেলে দীপঙ্করকেও (৩)। এতো শোক একটি পরিবার কতোক্ষণ সয়ে থাকবে। প্রতিবেশীরা পরিবারটিতে দু’দিন ধরে খাবার এনে দিলেও তা কেউ খাচ্ছেন, কেউ খাচ্ছেন না। গেদিপারা গ্রামের কৃষ্ণ চন্দ্র রায় (৫৬) ঘটনাস্থলে এসেছিলেন অষ্ট রায় (২০) ও মেয়ের ছেলে জগদিশ রায়কে (২৫) ফিরে পেতে। বলেন, রোববার অনেক রাত পর্যন্ত ছিলাম। আজও কোনোমতে দুই একটা কাজ করে সেই সকালে এসেছি।

কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো খবরই নাই। কি হবে, ভগবান কি রাগ করিছে? মা বেজ বালা (৫০), কাকিমা সুমি রানী (৩৫) বৌদি মণিকার (৩০) শুধু মরদেহগুলো দেখে শান্তি পেতে চান। বলেন, মা ও কাকি ছিলো নিজের বড় বোন ও ছোট বোনের মতো। মা যেমন কোনো ভালো কিছু রান্না করলে আগে কাকিমাকে দিতো, তেমনি ছিল কাকিমাও। তার বাসায় নতুন মেহমান আসলে সেটাও আগে মাকে জানাতো। তাদের আচরণ দেখে কেউ বলবে না তারা জা হন। এজন্যই তারা তাদের বৌমাকেও মহালয়ার উৎসবে নিয়ে যাচ্ছিলেন। হায় কপাল। একসঙ্গে তারা নিখোঁজও হয়ে গেলেন। তাদের চিন্তায় বাবা সকাল পর্যন্ত কিছু মুখে দেননি। একই গাঁয়ের অলেশ (২৫) বলেন, আমাদের বড় বাবা রাজমোহন অধিকারীই (৫২) সংসারের বড় কর্তা। আজকে তিনিই নাই। ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলেন, সংসারটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেলো। বাবাও চিরতরে অভিভাবক হারালেন। নৌকাডুবি থেকে বেঁচে ফেরা অবিনাশ মোদক (৪২) বলেন, আমরা পাঁচ বন্ধু নৌকায় ছিলাম। ভাগ্যক্রমে আমরা সাঁতরে পাড়ে উঠতে পারি। নয়তো অন্যদের মতো আমরাও নিখোঁজ থাকতাম। তার মতে, নৌকায় দেড়শ’র মতো আরোহী ছিলো। লোকজন ওঠার পরই নৌকায় পানি ঢুকতে থাকে। যে পাশেই লোক যাচ্ছিলো, সেপাশেই নৌকায় পানি ঢুকছিলো। অন্য যাত্রীরা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতি করছিলো। কিন্তু চরম মুহূর্তের বর্ণনা করতে পারবো না। তবে এতো মানুষ মারা যাবে তা বুঝতে পারিনি।

এদিকে রেলপথ মন্ত্রী এডভোকেট নূরুল ইসলাম সুজন ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান, দিনাজপুর-৬ আসনের এমপি মনোরঞ্জন শীল গোপাল দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে নিহতদের স্বজনদের সমবেদনা জানান। এ সময় রেলপথ মন্ত্রী আউলিয়ার ঘাটে পূর্ব প্রতিশ্রুত ওয়াই আকৃতির সেতু নির্মাণের প্রক্রিয়া দ্রুত কার্যকরের ঘোষণা দেন। একইসঙ্গে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বেদনাদায়ক এ দুর্ঘটনা সম্পর্কে অবগত আছেন এবং তিনি নিহতদের ও আহতদের পরিবারকে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন। হতাহতদের পরিবারের সদস্যদের প্রয়োজনীয় পুনর্বাসনেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান ধর্ম মন্ত্রণালয় হতে নিহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার করে চেক হস্তান্তর করেন। এর আগে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত প্রতি পরিবারের স্বজনদের হাতে লাশ সৎকারের জন্য ২০ হাজার টাকা ও আহতদের চিকিৎসায় ১০ হাজার টাকা করে প্রদান করা হয়।

মাড়েয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু মো. রেজাউল করিম শামীম বলেন, ইতোমধ্যে হতাহতরা জেলা প্রশাসকের প্রতিশ্রুত অর্থ পেয়েছেন। সরকারের প্রতিশ্রুত অর্থও তারা পেতে শুরু করেছেন।

পঞ্চগড় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সহকারী উপ পরিচালক শেখ মো. মাহাবুবুল আলম বলেন, সকাল থেকে পঞ্চগড় ও আশপাশের জেলার আটটি ফায়ার সার্ভিস ইউনিট উদ্ধার কাজ করছে। এর বাইরে রংপুর, কুড়িগ্রাম ও রাজশাহী থেকে তিনটি ডুবুড়ি দলে মোট ৯ জন উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন।

অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর কুমার রায় বলেন, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত নিখোঁজ থাকা ৬৫ জনের মধ্যে গত রোববার ২৫জন ও গতকাল ২৫জনের লাশ উদ্ধার করা গেছে। উদ্ধার অভিযান এখনো চলমান আছে। দুর্ঘটনা তদন্তে কমিটির প্রধান দীপঙ্কর কুমার রায় বলেন, তদন্ত চলমান আছে। তবে প্রাথমিকভাবে অতিরিক্ত যাত্রী থাকায় নৌকাডুবি হয়েছে বলে প্রমাণিত হয়েছে।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে বোদা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সোলেমান আলী বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবের মহালয়া উপলক্ষে শতাধিক মানুষ শ্যালো ইঞ্জিনচালিত একটি নৌকায় করে বদেশ্বরী মন্দিরের দিকে যাচ্ছিলেন। ঘাট থেকে নৌকাটি কিছু দূর যাওয়ার পর দুলতে শুরু করে। এ সময় মাঝি নৌকাটি ঘাটে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। একপর্যায়ে নৌকা ডুবে যায়। নৌকার যাত্রীদের অনেকেই সাঁতরে তীরে ওঠেন। তাদের চিৎকারে স্থানীয় লোকজন উদ্ধারকাজে যোগ দেন এবং পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ঘটনাস্থলে এসে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে উদ্ধারকাজ শুরু করেন।

পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, মৃতদের সৎকার ও দাফনপ্রক্রিয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে প্রতিটি পরিবারকে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তিদের প্রতি পরিবারকে এক লাখ টাকা করে দেয়া হবে। এদিকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিন্দুধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ২৫ হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছে। দুর্ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, বোদা উপজেলার মাড়েয়া ইউনিয়নের করতোয়া নদীর অপর পাড়ে বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়া পূজা উপলক্ষে প্রতি বছরের ন্যায় এবারো ধর্মসভার আয়োজন করা হয়। গত রোববার দুপুরের দিকে মূলত ওই ধর্মসভায় যোগ দিতে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা নৌকাযোগে নদী পার হচ্ছিলেন। তবে ৫০-৬০ জন ধারণ ক্ষমতার নৌকাটিতে দেড় শতাধিক যাত্রী ছিলো। অতিরিক্ত যাত্রীর কারণে নদীর মাঝপথে নৌকাটি ডুবে যায়। অনেকে সাঁতার জানায় তীরে আসতে পারলেও সাঁতার না জানা বিশেষ করে নারী ও শিশুরা পানিতে ডুবে যায়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More