ফেসবুক লাইভ করার দায় স্বীকার ফয়েজের : ইকবালসহ ৪ আসামি ৭ দিনের রিমান্ডে

স্টাফ রিপোর্টার: কুমিল্লায় পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনায় তিন আগন্তুকের (অপরিচিত ব্যক্তি) সন্ধানে নেমেছেন বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। গ্রেফতার হওয়া ইকবালের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ইতোমধ্যে তাদের গ্রেফতারে অভিযান শুরু হয়েছে। পূজাম-পে কোরআন রাখার কয়েকদিন আগে থেকেই ওই তিনজনের আনাগোনা ছিল ম-পের পাশে থাকা একটি মাজারে। কোরআন অবমাননার ঘটনায় তোলপাড় শুরু হলে লাপাত্তা হয়ে যায় তারা।
জানা যায়, ইকবাল সন্দেহভাজন ওই তিনজনের নাম না জানালেও আগন্তুকদের চেহারার বর্ণনা দিয়েছে। ওই বর্ণনা অনুযায়ী স্কেচ তৈরি করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। তাদের গ্রেফতার করতে পারলেই ঘটনার শিকড়ে পৌঁছুনো সম্ভব হবে।
সূত্র আরও জানায়, ওই তিন ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে এরই মধ্যে মাজার এবং এর আশপাশের এলাকার প্রতিটি সিসি ক্যামেরার ৫ থেকে ১৩ অক্টোবরের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দারা। এসব ফুটেজ পর্যালোচনা করে ইকবালের সঙ্গে মাজারে আসা-যাওয়া করা লোকজনের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। স্পর্শকাতর এ বিষয়টি তদন্তে তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যাতে কোনোভাবে কোনো ভুল পদক্ষেপ নেয়া না হয় এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে। গোয়েন্দারা জানান, ইকবাল কিছুটা অপ্রকৃতস্থ ও মাদকাসক্ত হওয়ায় ষড়যন্ত্রকারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী তাকে এ ভয়ংকর অপকর্ম করার জন্য বেছে নিয়েছে। মাদক কিংবা অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে হয়তো এ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এদিকে শনিবার ইকবালসহ ৪ আসামিকে ৭ দিনের রিমান্ডে নেয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। এদিন দুপুরে প্রধান আসামি ইকবাল এবং ঘটনার সময় জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ ফোন করা ইকরাম, ফয়সাল ও হাফেজ হুমায়ুনকে কুমিল্লার আদালতে হাজির করে পুলিশ। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার এসআই মফিজুল ইসলাম। তিনি আসামিদের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম মিথিলা জাহান নিপার আদালতে নিয়ে যান। সেখানে প্রত্যেকের ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানান। রিমান্ড আবেদনের শুনানি শেষে আদালত সবার ৭দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরআগে সকালে নগরীর নানুয়ার দীঘিরপাড় এলাকার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদের পৃথক দলও সেখানে যায়। এদিকে ম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুক লাইভে প্রচার করার দায় স্বীকার করেছে আইসিটি মামলার একমাত্র আসামি ফয়েজ আহমেদ।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ১৩ অক্টোবর কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দীঘিরপাড় এলাকায় দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত পূজাম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখেন আলোচিত যুবক ইকবাল হোসেন। এ সময় ৯৯৯-এ পুলিশকে প্রথমে খবর দেয় ইকরাম। একই সময় দারোগা বাড়ির শাহ আবদুল্লাহ গাজীপুরী মাজারের সহকারী দুই খাদেম হাফেজ হুমায়ুন এবং মো. ফয়সল একইভাবে পুলিশকে ফোন করেন। এ ঘটনায় সিসিটিভির ফুটেজ অনুসন্ধান করে প্রধান সন্দেহভাজন নগরীর সুজানগর এলাকার বাসিন্দা ইকবাল হোসেনকে শনাক্ত করে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে তাকে কক্সবাজার থেকে গ্রেফতার করে শুক্রবার কুমিল্লায় আনা হয়। পরে ঢাকা থেকে আসা পুলিশের উচ্চপর্যায়ের একটি তদন্ত দল তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জিজ্ঞাসাবাদে ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার কথা স্বীকার করে ইকবাল। এরআগে ৯৯৯ কল করা তিন আসামিকে গ্রেফতার করা হয়।
এ বিষয়ে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এম তানভীর আহমেদ বলেন, পুলিশর জিজ্ঞাসাবাদে ইকবাল পূজাম-পে কোরআন রাখার কথা স্বীকার করেছে। ঘটনার নেপথ্য কারণ জানতে ইকবালসহ চারজনকে পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ করতে সাতদিনের রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে। রিমান্ডে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে। তিনি বলেন, শুক্রবার রাত ৯টা পর্যন্ত পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে সে পূজাম-পে পবিত্র কোরআন রাখা, ম-পের প্রতিমা থেকে গদা সরিয়ে নিয়ে পুকুরে ফেলে দেয়ার কথা স্বীকার করে। তবে কোন পুকুরে ফেলে, সেটি বলেনি। তাকে নিয়ে পুলিশ ওই গদা উদ্ধার করবে। একই সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে অভিযানে যাবে। এ ঘটনায় জড়িত অন্যদের খুঁজে বের করা হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, সিআইডি হেফাজতে দুদিনের রিমান্ড শেষে আইসিটি মামলার একমাত্র আসামি ফয়েজ আহমেদ ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। জবানবন্দিতে সে ম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার ঘটনা তাৎক্ষণিকভাবে ফেসবুক লাইভে প্রচার করার কথা স্বীকার করে।
এ বিষয়ে শনিবার সিআইডির পুলিশ সুপার খান মোহাম্মদ রেজওয়ান বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে ফয়েজ জানায়, ঘটনার দিন সকালে হাঁটতে বের হয় সে। পথিমধ্যে পূজাম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার খবর জেনে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে তাৎক্ষণিকভাবে নিজের ফেসবুক আইডি থেকে বিষয়টি লাইভে প্রচার করেন। পাশাপাশি তার আটজন বন্ধুকে মেসেঞ্জারের মাধ্যমে লিংক শেয়ার করেন।
চট্টগ্রাম রেঞ্জের এক কর্মকর্তা জানান, গ্রেফতার ইকবালের কাছ থেকে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। তার কথার মাঝে কিছু অসংলগ্নতা রয়েছে। এ কারণে তাকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে আরও কয়েকজনের সন্ধান করা হচ্ছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ইকবালকে গ্রেফতারের পর তাকে প্রথমে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ে। এরপর সেখানে যান পুলিশের আরও একাধিক ইউনিটের সদস্য। সেখানে রাতভর তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর ভোরে কুমিল্লা জেলা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কুমিল্লা জেলা পুলিশ লাইনে নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন ও অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের চৌকস কর্মকর্তারা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।
জিজ্ঞাসাবাদে ইকবালের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের বরাত দিয়ে সূত্র জানায়, চুরির অপবাদে ঘর ছাড়ার পর গত ২০ দিন ধরে সে ওই মাজারে অবস্থান করছিল। সেখানেই ১০-১২ আগে তার সঙ্গে পরিচয় হয় তিন আগন্তুকের সঙ্গে। তারা এলাকার পরিচিত মুখ না হওয়ার কারণে প্রথমদিকে সে তাদের এড়িয়ে চলতে থাকে। একপর্যায়ে নেশার জন্য তাদের সঙ্গে মিশতে থাকে। মাজার ভক্তেরবেশে থাকা ওই ব্যক্তিরা তাকে গাঁজা ও ইয়াবা সেবনের ব্যবস্থা করে। এমনকি প্রতিদিন ভাত খাওয়ার টাকাও সরবরাহ করতে থাকে। এরপর তাদের সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। ওই আগন্তুকরা মাজারে রাত যাপন না করলেও প্রতিদিনই সেখানে আসা-যাওয়া করত। গভীর রাত পর্যন্ত ইকবালের সঙ্গে নেশা করত। পূজা শুরু করে তারা ইকবালকে মাজারের পাশে মন্দির থাকার কারণে ইসলাম ধর্ম অবমাননা হচ্ছে বলে বিভিন্ন সময় উত্তেজিত করতে থাকে। এ বিষয়ে ইকবালের ভূমিকা রাখা উচিত বলেও তারা মন্তব্য করে। ঘটনার দিন রাতে তারা একসঙ্গে মাজারের পাশে বসে গাঁজা সেবন করে। পরে তারা ইকবালকে পূজাম-পে কোরআন রাখতে বলে। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে হাত মেলায় মাজার-মসজিদের কর্মী মো. হুমায়ুন কবির ও খাদেম মোহাম্মদ ফয়সলও। তাদের কথামতো ইকবাল একটি কোরআন নিয়ে ম-পে রেখে আসে। এমনকি ঘটনার দিন সকালে সে মন্দির ভাঙচুরেও অংশ নেয়। বিষয়টি গ্রেফতারকৃত মাজারের কর্মী এবং খাদেমও স্বীকার করেছে।
ইকবালকে জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা জানান, ম-পে কোরআন শরিফ রেখে আসা এবং হনুমানের মূর্তির হাত থেকে গদা সরিয়ে নেয়ার কথা ইকবাল নিঃসংকোচে স্বীকার করছে। কিন্তু কে বা কারা তাকে দিয়ে এ কাজ করিয়েছে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু এখনও জানায়নি। এমনকি ঘটনার আগে যে তিন ব্যক্তি তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করেছে এবং একসঙ্গে মাজারে যাতায়াত করেছে তাদের ব্যাপারেও তথ্য দিচ্ছে না। কখনও বলছে, বহিরাগত ২-৩ জন তাকে এটা-ওটা খাইয়েছে, গাঁজা-ইয়াবাও দিয়েছে। তার সঙ্গে ধর্ম-অর্ধম, মাজার-মন্দির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছে।
এদিকে শনিবার সকালে নানুয়ার দীঘিরপাড় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল। এ সময় প্রতিনিধি দলটি স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলেন। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় সাংবাদিকদের বলেন, এ সরকার জনবিচ্ছিন্ন একটি সরকার। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্যই সরকার এসব নাটক করছে। একই সময় হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বে জাসদের একটি প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এ দলে অন্যদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেতা মোজাফফর আহমেদ পল্টু এবং সাংবাদিক আবেদ খান।
১৩ অক্টোবর কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দীঘিরপাড় এলাকায় একটি অস্থায়ী পূজাম-পে পবিত্র কোরআন রাখার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার জের ধরে দেশজুড়ে চলে ব্যাপক সহিংসতা। এ ঘটনাকে পুঁজি করে একটি চক্র দেশের পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা করে। এরই মধ্যে সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে ম-পে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখা ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More