মুক্তিপণের জন্য নৃশংসতা, শিশু আয়াতকে ছয় টুকরো করে সাগরে নিক্ষেপ

স্টাফ রিপোর্টার: দশদিন আগে নিখোঁজ হয় পাঁচ বছরের শিশু আলীনা ইসলাম আয়াত। শুক্রবার পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) জানিয়েছে, শিশুটিকে নিখোঁজের দিনই হত্যা করে তাদের ভবনের ভাড়াটিয়া আজহারুল ইসলামের ছেলে আবীর আলী (১৯)। এক বাসায় শ্বাসরোধ করে শিশুটিকে হত্যা করে আবীর। সেই লাশ প্যাকেটে মুড়িয়ে আরেক বাসায় নিয়ে কেটে ছয় টুকরো করা হয়। এরপর সাগরে আর খালে ছড়িয়ে দেয়া হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে আবীরকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর শিশুটিকে হত্যার এমন লোমহর্ষক তথ্য পায় পিবিআই। শুক্রবার তাকে নিয়ে নগরের ইপিজেড থানার আকমল আলী রোড ও সাগরপাড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত বটি ও শিশুটির পায়ের স্যান্ডেলসহ বিভিন্ন আলামত উদ্ধার করে পুলিশ। তবে শিশুটির লাশের টুকরোর খোঁজ এখনও মেলেনি। পুলিশের ধারণা, লাশের টুকরোগুলো সাগরে ভেসে গেছে।

পিবিআই কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শিশুটিকে অপহরণ করেছিলো আবীর। কোথাও লুকিয়ে রাখতে না পেয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে। পরে লাশের টুকরোগুলো তিনটি প্যাকেটে মুড়িয়ে সাগর ও খালের দুইটি জায়গায় ছড়িয়ে দিয়েছে। ভারতীয় টিভি শো ক্রাইম পেট্রোল ও সিআইডি দেখে হত্যাকা- ও আলামত লুকিয়ে ফেলার এমন নৃশংস ও ভয়ঙ্কর কৌশল রপ্ত করেছে বলে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছে আবীর।

নিহত শিশু আলীনা ইসলাম আয়াত ইপিজেড থানার দক্ষিণ হালিশহর বন্দরটিলা নয়ারহাট ওয়াজ মুন্সীর নতুন বাড়ির সোহেল রানার মেয়ে। সে স্থানীয় তালীমূল কোরআন নূরানী মাদ্রাসার ছাত্রী ছিলো। গত ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাসা থেকে বের হয় আয়াত। এরপর শিশুটিকে নানা জায়গায় হন্যে হয়ে খোঁজ করেন পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় শিশুটির দাদা মনজুর হোসেন ইপিজেড থানায় জিডি করেন।

পিবিআই জানায়, আয়াতদের ভবনের নিচতলায় দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকতেন রংপুরের তারাগঞ্জ থানার ঘনিরামপুর গ্রামের আজহারুল ইসলাম। চলতি মাসের শুরুতে তার স্ত্রী আলো বেগম আকমল আলী রোডের পকেট গেইট এলাকায় আলাদা বাসা নেন। সেখানে মায়ের সঙ্গে আবীর ও বোন আঁখি থাকতেন। বাবার বাসায়ও আবীরের আসা-যাওয়া ছিল। আয়াত নিখোঁজ হওয়ার পর তদন্ত শুরু করে পিবিআই। তারা ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। একটি ফুটেজে আবীরকে দুইটি ব্যাগ নিয়ে যেতে দেখা যায়। পিবিআই কর্মকর্তারা তার মায়ের বাসায় গিয়ে ব্যাগ দুইটি খুঁজতে থাকেন। একটি ব্যাগ পেলেও অন্যটি পাননি। তখন তাদের সন্দেহ হয়। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আবীরকে নিয়ে পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে আসা হয়। একপর্যায়ে হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করে আবীর।

পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রোর পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, ‘তদন্তে নেমে আয়াতের সমবয়সী যারা সবসময় একসঙ্গে খেলাধূলা করত, তাদের সঙ্গে কথা বলি। বাচ্চারা একটা কথা বলেছে যে, আয়াতকে আবীর চাচ্চু কোলে নিয়েছে। তখন আমরা আবীরকে জিজ্ঞেস করি যে, তুমি বাচ্চা কোলে নিয়েছ, এই বাচ্চা গেল কোথায়? সে বলে, আমি আদর করে রেখে দিয়েছি। তবে সিসিটিভি ফুটেজে তার হাতে একটি বড় ব্যাগ দেখে সন্দেহ হয়। পরে সেটি তার বাসায় খুঁজে না পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে তাকে আটক করে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে একপর্যায়ে সে হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করে।

পিবিআই এ কর্মকর্তা জানান, জিজ্ঞাসাবাদে সে বারবার পুলিশকে বলছে ‘আমি এভিডেন্স সরিয়ে ফেলেছি, লুকিয়ে ফেলেছি’।

পিবিআই মেট্রোর পরিদর্শক মর্জিনা আক্তার সমকালকে বলেন, ‘আয়াতকে কোলে নেয়ার সময় তার জুতো জোড়া পড়ে গিয়েছিলো। পরে আবীর আয়াতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খোঁজাখুজির সময় জুতো জোড়া নিয়ে বাসার সঙ্গে লাগোয়া কবরস্থানে ফেলে দেয়। জুতো সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া দোকান থেকে স্কচটেপ, পলিথিন ও কার্টার সংগ্রহ করার ফুটেজও পাওয়া গেছে। লাশ টুকরো করার বটিও উদ্ধার করা হয়েছে।’

পিবিআই মেট্রোর পরিদর্শক ইলিয়াস খান বলেন,‘আবীরের উদ্দেশ্যে ছিল আয়াতের পরিবারের কাছ থেকে টাকা আদায় করা। এ জন্য সে ছয়মাস আগে থেকে পরিকল্পনা করছিল। কয়েক মাস আগে রাস্তায় একটি সিম খুঁজে পায় আবীর। আয়াতকে হত্যার পর তার মায়ের সেলাই মেশিন বিক্রি করে ৩০০ টাকায় একটি বাটন ফোন কিনে। মুক্তিপণ দাবির জন্য সে মোবাইলে সিমটি ঢোকায়। কিন্তু সিমটি কাজ না করায় আর মুক্তিপণ চাইতে পারেননি। অন্য মোবাইল ফোন থেকে দাবি করলে ধরা পড়ে যাবে এজন্য সে আর মুক্তিপণ চায়নি। তবে হাসিব নামে এক বন্ধুকে আয়াতকে হত্যার কথা বলেছিল। সেও কাউকে জানায়নি। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে।’

এদিকে পরিবারের আদরের সন্তানকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন আয়াতের পরিবার। শুক্রবার দুপুরে তাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায় স্বজনদের ভিড়। মা সাহিদা আক্তার তামান্নার আহাজারি থামছে না। টাকার জন্য আবীর আয়াতকে হত্যা করতে পারে এটা বিশ্বাস করতে পারছেন না প্রতিবেশীরা।

এদিকে নাতনিকে হারিয়ে মুষড়ে পড়েছেন দাদা মনজুর হোসেন। তিনি কান্নারত অবস্থায় বলেন, ‘আবীর এখানে বেড়ে উঠেছে। ভয়ঙ্কর অপরাধীর মতো আমার ছোট নাতনিকে এমন নৃশংসভাবে হত্যা করবে; আমরা ধারণাও করতে পারিনি। আমাদের সব শেষ হয়ে গেছে। আমরা আবীরের ফাঁসি চাই।’

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More