আটা-ময়দার দাম কেজিতে ৮-১০ টাকা বৃদ্ধি : চালের দাম আরও বাড়ার শঙ্কা

গমের দাম বাড়লেও বিদেশের বাজার থেকে কেনা কোনো গম দেশে এখনও আসেনি

স্টাফ রিপোর্টার: দেশে গমের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে, এ নিয়ে আশঙ্কার কোনো কারণ নেই- বাণিজ্যমন্ত্রী এমন দাবি করলেও বাস্তবতা পুরোপুরি ভিন্ন। ভারত থেকে গম রপ্তানি বন্ধের ঘোষণার চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে খুচরা বাজারে আটার দাম কেজিতে ৮ থেকে ১০ টাকা এবং ময়দার দাম ৬ টাকা বেড়েছে। আগামীতে দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে। এ সুযোগে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট বিভিন্ন গুদাম ও মিলে হাজার হাজার টন গম মজুত করে চলমান সংকট আরও বাড়ানোর অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এ কারসাজিতে গমের বাজার আরও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার শঙ্কা রয়েছে। গমের দাম বাড়লে চালের দাম আরও বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকারের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বেশকিছু সুপারিশ করেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যে গমের মজুত রয়েছে, তাতে আগামী দুই মাস ভালোভাবেই কেটে যাওয়ার কথা। অথচ বাজার ব্যবস্থাপনায় নানা দুর্বলতা, আমদানিকৃত পণ্যের নজরদারিতে ঘাটতি ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সরকারিভাবে খাদ্যশস্য সংগ্রহ অভিযান পুরোপুরি সফল না হওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সয়াবিন তেলের মতো গমের বাজারেও নানা তেলেসমাতি ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব ব্যাপারে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ সরকারের সংশ্লিষ্ট সব প্রশাসনকে সর্বোচ্চ সতর্কতার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি অবৈধভাবে মজুত বাড়িয়ে বিশেষ কোনো সিন্ডিকেট যাতে গমের বাজার অস্থিতিশীল করে তুলতে না পারে এজন্য দ্রুত সাঁড়াশি অভিযান চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে।

বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে ফ্লাওয়ার মিল মালিক, আমদানিকারক ও বড় বড় ব্যবসায়ীদের গুদামে কী পরিমাণ গম মজুত আছে সে তথ্য সরকারের হাতে নেই। তাদের কার কোথায় কী পরিমাণ শস্য মজুত রাখার গোডাউন আছে, সে ব্যাপারেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন ওয়াকিবহাল নয়। এমনকি এ সংক্রান্ত কোনো নথিপত্রও নেই তাদের কাছে। ফলে অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামলেও দ্রম্নত আশানুরূপ সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা কম। এজন্য সবার আগে মজুতের পরিমাণ ও স্থান শনাক্ত করা জরুরি।

ভারত রপ্তানি বন্ধের পর আন্তর্জাতিক বাজারে গমের দাম বাড়লেও বিদেশের বাজার থেকে কেনা কোনো গম দেশে এখনও আসেনি। এ অবস্থায় দেশীয় বাজারে গমের দাম উচ্চ লাফে বেড়ে যাচ্ছে মজুতদার, আমদানিকারক ও বড় ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের পর গত ১ মার্চ থেকে ১২ মে পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে ৬ লাখ ৮৭ হাজার টন গম আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারত থেকে এসেছে ৪ লাখ ৩২ হাজার টন। যা মোট আমদানির প্রায় ৬৩ শতাংশ। বাকি গম অন্যান্য ৮টি দেশ থেকে আনা হয়েছে।

অন্যদিকে বাণিজ্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারিভাবে গমের মজুত আছে এক লাখ ২০ হাজার মেট্রিক টন। গত ১৬ মে ৫০ হাজার টন সরকারি গম নিয়ে ‘ইমানুয়েল সি’ জাহাজটি ভারত থেকে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেছে। আজকালের মধ্যে আরও ৫০ হাজার টন গম নিয়ে আরেকটি জাহাজ চট্টগ্রাম পৌঁছাবে।

বর্তমানে ২০২১-২২ অর্থবছরের জুলাই থেকে ১৬ মে পর্যন্ত সাড়ে ১০ মাসে সরকারিভাবে গম আমদানি হয়েছে চার লাখ ৪১ হাজার টন। এবার সরকারিভাবে সাড়ে ছয় লাখ টন গম আমদানির লক্ষ্যমাত্রা ছিলো। সে হিসাবে জুনের মধ্যেই আরও অন্তত দুই লাখ টন গম আসার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ডক্টর মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম জানান, তারা এরই মধ্যে দু’টি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তার একটি বুলগেরিয়ার সঙ্গে গম আমদানি নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই। অন্যটি ভারত সরকারের সঙ্গে জি-টু-জি পদ্ধতিতে গম আমদানি করার চেষ্টা। মন্ত্রণালয় সরকারিভাবে বেশি গম এনে খোলা বাজারে বা ওএমএস-এর মাধ্যমে বেশি করে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বছরে বাংলাদেশে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্যের প্রয়োজন হয় তার মধ্যে রয়েছে ৫৮ লাখ টন গম। এর মধ্যে দেশে গম উৎপাদন হয় ১২ লাখ টনের কিছু বেশি। ফলে মোট চাহিদার চার-পঞ্চমাংশ পূরণ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। অর্থাৎ ৪৬ লাখ টন বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর মধ্যে সরকারিভাবে আমদানিকৃত সাড়ে ৬ লাখ টন বাদ দিলে বেসরকারিভাবে আমদানিকৃত গমের পরিমাণ সাড়ে ৩৯ লাখ টন। যার কাগুজে হিসাব সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে থাকলেও আমদানিকৃত পণ্যের মজুতের পরিমাণ ও এর মজুতের অবস্থান সব সময়ই অস্পষ্ট।

এদিকে শুধু আমদানিকৃত গমই নয়, দেশের বাজার থেকে বড় বড় ব্যবসায়ীরা কী পরিমাণ গম সংগ্রহ করছে তার সঠিক চিত্রও নেই খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হাতে। পাশাপাশি সরকারিভাবে মজুতের লক্ষ্যে কৃষকের কাছ থেকে গম সংগ্রহের ক্ষেত্রে নতুন করে দেখা দেয়া সঙ্কট মোকাবিলাতেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় আশানুরূপ তৎপরতা দেখাতে পারেনি।

মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার পর দেশের বাজারে গমের দাম বাড়লেও সরকারিভাবে নির্ধারিত দাম আগের জায়গাতেই রয়েছে। ফলে চলতি মৌসুমে খাদ্য বিভাগ পর্যাপ্ত গম সংগ্রহে ব্যর্থ হচ্ছে। বেশকিছু জেলায় গম সংগ্রহ অভিযান অনেকটা থমকে গেছে।

খাদ্য বিভাগের জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তারা জানান, সরকারিভাবে প্রতি কেজি গমের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ২৮ টাকা। আর হাটবাজারে প্রতি কেজি গম ৩১ টাকা থেকে ৩২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাই কৃষকরা আগে খাদ্য বিভাগের কাছে গম বিক্রি করলেও এখন খোলা বাজারে ছুটছেন। নানাভাবে বুঝিয়েও তাদের ফেরানো যাচ্ছে না। এ সুযোগে ফ্লাওয়ার মিল মালিক, মৌসুমী মজুতদার, ফটকা কারবারি ও বড় ব্যবসায়ীরা দেশে উৎপাদিত গমের একটি বড় অংশ সহজেই কৃষকদের কাছ থেকে কিনে নিচ্ছেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে জানান, কেজিপ্রতি ৩/৪ টাকা গচ্চা দিয়ে কেউই তাদের কাছে গম বিক্রি করতে চাইছেন না। ফলে তারা বেশ খানিকটা বিপাকে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতি চলমান থাকলে চলতি মৌসুমে সরকারিভাবে গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার সুযোগ নেই। আর্থিক অসঙ্গতি এবং মজুতের ব্যবস্থা না থাকায় কৃষকরা এখনই তাদের উৎপাদিত গম বিক্রি করে দেবে। তাই পরে সরকারিভাবে দাম বাড়ানো হলেও গম সংগ্রহ অভিযানে কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে না। বরং সে মুনাফা মজুতদারের পকেটেই ঢুকবে।

‘গমের রাজধানী’ হিসেবে খ্যাত ঠাকুরগাঁওয়ের একজন কৃষকের কাছে মুঠোফোনে এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, এ বছর গমের উৎপাদন যথেষ্ট ভালো হয়েছে। গত বছর একর প্রতি ৪০-৪৫ মণ হলেও এবার ফলন হয়েছে একর প্রতি ৫৫-৬০ মণ। এখান থেকে খাদ্য অধিদপ্তর এবার ১ লাখ মেট্রিক টন গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে সরকার খোলাবাজারের চেয়ে কেজিপ্রতি ৩/৪ টাকা কম দাম নির্ধারণ করায় বেশিরভাগ গম পাইকার ও মজুতদারদের হাতে চলে যাচ্ছে।

ঠাকুরগাঁও জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মনিরুল ইসলাম বিষয়টি স্বীকার করে চলতি মৌসুমে এ জেলায় সরকারিভাবে গম সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।

এদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, মাঠ পর্যায়ের খাদ্য কর্মকর্তাদের গমের অবৈধ মজুতের তথ্য দিতে বলা হচ্ছে। এরপর এই তথ্য অনুযায়ী মজুতদারদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে সরকার। এছাড়া খাদ্যশস্য লাইসেন্স ব্যতীত কোনো ব্যবসায়ী এক মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য/খাদ্য সামগ্রী রাখতে পারবে না। লাইসেন্স থাকলেও নিয়মবহির্ভূতভাবে যেসব গুদাম ও মিলে অবৈধ মজুত রয়েছে সেসব স্থানে অভিযান চালানো হবে। যেসব ব্যক্তি এসব অবৈধ মজুতের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দেয়া হয়েছে।

এদিকে বেসরকারি পর্যায়ে মজুতের প্রকৃত চিত্র পাওয়া না গেলেও সংশ্লিষ্টদের ধারণা, বড় বড় ফ্লাওয়ার মিল মালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে অন্তত ১৫ থেকে ৩০ দিনের গম মজুত রয়েছে। আগামীতে দাম আরও বাড়বে এ প্রত্যাশায় এদের অনেকে মজুত করা পণ্য সিন্ডিকেট করে বিক্রির পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। তবে ফ্লাওয়ার মিল মালিক সমিতির নেতাদের দাবি, আমদানিকারকরাই মূলত সিন্ডিকেট করে গমের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়া বড় বড় ব্যবসায়ীদের অনেকের কাছে দুই-তিন মাসের গম মজুত রয়েছে। এসব গম বাজারে ছাড়া হলে পরিস্থিতি আপাতত অনেকটাই সামাল দেয়া যাবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More