আসামীর স্বীকারোক্তি : অতিরিক্ত মদপান করিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে খুন করা হয় সবুরকে

আলমডাঙ্গার হারদীর পানব্যবসায়ী হত্যাকাণ্ড

 আদালতে ১৬৪ ধারায় বোমারু জামালের স্বীকারোক্তি রেকর্ড
আলমডাঙ্গা ব্যুরো: আলমডাঙ্গার হারদী গ্রামের পানব্যবসায়ী আব্দুস সবুর (৩৭) হত্যাকা-ের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দিলেন হারদীর জামাল হোসেন ওরফে বোমারু জামাল ওরফে শুটার জামাল (৩৭)। শুধুমাত্র পাওনা বেতনের টাকা পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পেয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে। ২৭ নভেম্বর রাতে পুলিশ তাকে ও এ হত্যাকা-ে জড়িত একই গ্রামের কাবের আলীকে (৪০) গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারের পর তাদেরকে গতকাল শনিবার সিনিয়র জুডিসিয়াল আদালতে হাজির করা হয়। ইতঃপূর্বে ২৩ নভেম্বর এ হত্যাকা-ে জড়িত সন্দেহে নিহতের চাচাশ্বশুর ও পারিবারিক ভ্যানচালক কিরণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক জামাল ও কাবের আলীকে গ্রেফতার করা হয়।
জানা যায়, গত বছরের ২২ জুন রাতে আলমডাঙ্গার হারদী গ্রামের আব্দুস সবুর (৩৬) নামের এক পানব্যবসায়ী যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। ভোরে নিজঘরের খাট থেকে তার লাশ পুলিশ উদ্ধার করে। হত্যাকা-ের পর আব্দুস সবুরের স্ত্রী সালমা খাতুন জানান, আব্দুস সবুর যে রুমে রাত কাটাতেন তার পাশের রুমেই সন্তানসহ তিনি (স্ত্রী) থাকতেন। বন্ধুদের সাথে আড্ডা শেষে আব্দুস সবুর সাধারণত রাত ১টা থেকে দেড়টার দিকে বাড়ি ফিরতেন। বাড়ি ফিরে তিনি তাকে (স্ত্রীকে) ডেকে তুলতেন। কিন্তু ঘটনার রাতে তার আচরণের ব্যত্যয় ঘটে। ২১ জুন রাত ১০টার দিকে আব্দুস সবুর বাড়ি থেকে খেয়ে স্ত্রী সালমা খাতুনের নিকট থেকে ১শ টাকা চেয়ে নিয়ে বাইরে যায়। কখন ফিরে এসেছিলেন তা তিনি জানতে পারেননি। ভোর ৩টার দিকে একটা শব্দ শুনে তার ঘুম ভেঙে যায়। সে সময় তিনি নিজের রুম থেকে বের হয়ে স্বামীর (আব্দুস সবুরের) রুমে যেতে চেষ্টা করেও পারেননি। কেউ বাইরে থেকে তার রুমের দরজার শেকল আগে থেকেই আটকে দিয়েছিলো। সে সময় তার চিৎকারে প্রতিবেশীরা ছুটে গিয়ে তার রুমের শেকল খুলে দেয়। তিনি রুম থেকে বের হয়ে দেখেন স্বামীর রুমের দরজা খোলা। ভেতরে গিয়ে খাটে শুয়ে থাকাবস্থায় স্বামী আব্দুস সবুরের গুলিবিদ্ধ লাশ দেখতে পান। আব্দুস সবুরকে শাবল বা ভারি কোন কিছু দিয়ে কপালে আঘাত করে হত্যা করা হতে পারে বলে পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারনা করেছিলো। কিন্তু ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের বক্তব্য পুলিশের ধারনা পাল্টে দেয়। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক আবাসিক মেডিকেল অফিসার ডা. শামীম কবীর জানান, শর্টগান অথবা ওয়ান শুটার গানের গুলিতে আব্দুস সবুরের মৃত্যু ঘটেছে। তার মস্তিষ্কের ভেতরে শর্টগান বা ওয়ান শুটার গানের গুলির ৩৬টি স্পিন্ডার পাওয়া গিয়েছিলো। এ ঘটনায় নিহতের স্ত্রী বাদী হয়ে সে সময় আলমডাঙ্গা থানায় এজাহার দায়ের করে। তবে সে এজাহারে কাউকে আসামি বা সন্দেহ করা হয়নি। তবে পুলিশ ঘটনার দিনেই হারদী গ্রামের মৃত কালু ম-লের ছেলে মনির ও একই গ্রামের মৃত কলিম উদ্দীনের ছেলে আতিয়ারকে আটক করে। তারা দুজনেই নিহত আব্দুস সবুরের বন্ধু। সে সময় পুলিশ তাদের নিকট থেকে এ হত্যাকা-ের বিষয়ে কোনো তথ্য উদ্ধার করতে পারেনি। দীর্ঘ ১ বছরের অধিক সময়েও পুলিশ এ হত্যাকা-ের রহস্যের কোনো কুলকিনারা করতে পারেনি। সাধারণ মানুষও সবুর হত্যাকা-ের কথা ভুলতে বসেছিলো। কিন্তু আলমডাঙ্গা থানার বর্তমান অফিসার ইনচার্জ আলমগীর কবীরে নির্দেশনায় ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মাসুদুর রহমানের নেতৃত্বে বেশ কিছুদিন ধরে পুলিশ এ হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচনের জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এরই প্রেক্ষিতে সবুর হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচিত হলো।
নিহত সবুর গভীররাত পর্যন্ত তিনি সবান্ধবে নেশা করতেন। নিজের উপার্জন তো বটেই, তার স্ত্রীর বেতনের টাকাও দেদারচ্ছে উড়াতেন নেশার পেছনে। আব্দুস সবুরের স্ত্রী সালমা খাতুন পল্লীবিদ্যুত সমিতির আলমডাঙ্গা অফিসে কর্মরত। এ নেশা করা নিয়ে স্ত্রীর সাথেও তার সম্পর্কের অবনতি ছিলো। হত্যাকা-ের ১০-১২ দিন আগে স্ত্রীকে পিটিয়ে আহত করে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলো। এ বিষয়টি জানার পর পুলিশের বদ্ধমূল ধারণা জন্মে যে, পারিবারিক অশান্তিই এ হত্যাকা-ের কারণ হতে পারে। এ বিষয়টি সামনে নিয়ে পুলিশ ব্যাপক তদন্ত শুরু করে। নিহতের ও তার ঘনিষ্ঠদের মোবাইলফোনের কললিস্ট চেক করা হয়। যে সব নম্বর থেকে অস্বাভাবিকভাবে অতিরিক্ত যোগাযোগ করা হয়েছে তাদেরকে টার্গেট করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করা হয়। এক পর্যায়ে এ হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের পরিচয় বের হয়ে আসে বলে একটি সূত্র দাবি করে।
গত ২৩ নভেম্বর রাতে পুলিশ এ হত্যাকা-ের সাথে জড়িত সন্দেহে মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার কুমারীডাঙ্গা গ্রামের মৃত জহির উদ্দীনের ছেলে শফি উদ্দীনকে (৫০) আটক করে। গ্রেফতার শফি উদ্দীন নিহত আব্দুস সবুরের চাচাশ্বশুর। পরে একই রাতে হারদী গ্রামের রিকন শেখের ছেলে পাখিভ্যান চালক কিরণ শেখকেও (২১) আটক করা হয়। আটককৃত কিরণ শেখের ভ্যানে নিহত আব্দুস সবুরের শিশুসন্তান ও স্ত্রী যাতায়াত করতেন। তাদেরকে আটক করতে পুলিশকে বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করতে হয় বলে জানা যায়। তারা এ হত্যাকা-ের সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়।
তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক গত ২৭ নভেম্বর রাতে পুলিশ পরিদর্শক তদন্ত মাসুদুর রহমান, এসআই খসরু আলম, এসআই সুফল কুমার, কনস্টেবল শাহরিয়ার ও রফিকুল ইসলামসহ সঙ্গীয় ফোর্স জামাল হোসেন ওরফে বোমা জামাল ওরফে শুটার জামালকে তার মামাবাড়ি আলমডাঙ্গার গোবিন্দপুর থেকে আটক করা হয়। একই রাতে নিজবাড়ি থেকে ডাকাত কাবেরকে আটক করে। জামাল হারদী গ্রামের কাতব আলীর ছেলে ও কাবের আলী একই গ্রামের মেছের আলীর ছেলে। রাতেই তাদেরকে পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যাকা-ের রহস্য উন্মোচিত হতে শুরু করে। পরদিন ২৮ নভেম্বর সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করা হলে জামাল হোসেন নিজেকে হত্যাকা-ে সম্পৃক্ত করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী প্রদান করে বলে জানা যায়।
একাধিকসূত্রে জানা যায়, সবুর হত্যাকা-ের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত জামাল হোসেন ওরফে বোমারু জামাল ওরফে শুটার জামাল ও ডাকাত কাবের দুজনই নিহত সবুরের ঘনিষ্ঠজন। তারা তিনজনই একসময় আন্ডারওয়ার্ল্ডের নটরাজ হারদী গ্রামের সন্ত্রাসী আরিফের সহযোগী ছিলেন। আরিফের সকল অপকর্মের সাথী। বোমাঘাতে আরিফ নিহত হওয়ার পর সবুর পানব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসার কর্মচারী হিসেবে রাখেন পুরোনো বন্ধু বোমারু জামাল ও ডাকাত কাবের আলীকে। বিয়ের পর সুদর্শন সবুর পল্লী বিদ্যুতে চাকরি পাওয়া সালমা খাতুনকে অনেকটা ট্রাপে ফেলে বিয়ে করেন। অবশ্য এর পূর্বে সালমা খাতুন একাধিকবার অন্যান্য যুবককে বিয়ে করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। বিয়ের পরও মাত্রাতিরিক্ত মদ পান অব্যাহত রাখেন সবুর। বেহিসেবি সবুর ব্যবসার পুঁজি সবই শেষ করে ফেলেন। স্ত্রীর বেতনও সব খরচ করে ফেলতেন। বেশ কয়েকবার শ্বশুরের নিকট থেকেও টাকা নেয়। এমনকি শেষ পর্যন্ত শ্বশুর লোন নিয়ে তাকে টাকা দেয়। সব অর্থ নেশার পথে খরচ করে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। তার কর্মচারী জামাল ও কাবের আলীর কয়েক মাসে বেতন বাকি হয়ে যায়। এই নিয়ে স্ত্রীর সাথে তার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। নিহত হওয়ার ১০-১২ দিন আগে সবুর স্ত্রীকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠায়। এরপর সবুর হত্যার চূড়ান্ত ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করা হয়। হত্যার জন্য সবুরের চাচাশ্বশুর শফি উদ্দীন আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহ করেন। সবুরের পারিবারিক পাখিভ্যান চালক কিরণ গিয়ে চাচাশ্বশুরের বাড়ি থেকে কাঠালভর্তি দুটি বস্তা নিয়ে সবুরের বাড়িতে যায়। একটি বস্তায় আগ্নেয়াস্ত্র একটি ওয়ান শুটারগান লুকিয়ে নিয়ে আসা হয়। আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আসার জন্য ওইদিন হত্যার নেপথ্য অবস্থানকারী পাখিভ্যান চালক কিরণকে অসংখ্য বার রিঙ দেন।
ঘটনার রাতে জামাল, কাবের, কিরণসহ ১০-১২ জন যুবক সবুর আলীকে কৌশলে রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার দিকে মাঠে নিয়ে যায়। তাকে উপর্যপুরি মদ পান করায়। এক পর্যায়ে সবুর অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অজ্ঞান অবস্থায় ঘাড়ে করে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। পথের ভেতর অজ্ঞান অবস্থায় বমিও করেন। পরে নিজের ঘরের বেডে শুইয়ে রাখা হয়। সে সময় সবুর ছিল মৃতপ্রায়। ঘাতকদের ধারণা ছিলো অতিরিক্ত মদপানের কারণে এমনিতে সবুরের অবস্থা এতোটাই শোচনীয় ছিলো; যে তিনি মারা যেতেন। কিন্তু ঘাতকরা কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। তাই মাথায় নল ঠেকিয়ে ঠা-া মাথায় তাকে খুন করা হয়। কাবের নিজে শুট করে। ঘাতকরা চলে যাওয়ার আগে সবুরের স্ত্রীর রুমের দরজার শেকল বাইরে থেকে তুলে দেন।
আলমডাঙ্গা থানার অফিসার ইনচার্জ আলমগীর হোসেন জানান, জামাল, কাবের ও কিরণ নিহত সবুরের নিকট কয়েক মাসের বেতন পেতেন। শুধুমাত্র বকেয়া বেতন পরিশোধের প্রতিশ্রুতি পেয়ে ঘাতকরা এ হত্যাকা- ঘটায়। তবে কে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো সে সম্পর্কে মুখ খোলেনি।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More