গাংনীর কুখ্যাত দুই সুদখোর গ্রেফতার : সাদা স্ট্যাম্প ও ব্লাঙ্ক চেক উদ্ধার

গাংনীর উত্তরপাড়ার কথিত উত্তরা ব্যাংকে পুলিশের সাহসী অভিযান

গাংনী প্রতিনিধি: মেহেরপুরের গাংনীর উত্তরপাড়ায় অভিযান চালিয়ে সুদ ব্যবসায়ী আবু হানিফ (৪৪) ও আনারুল ইসলামকে (৫৫) গ্রেফতার করেছে পুলিশ। সুদ কারবারের কাজে ব্যবহৃত তিন শতাধিক ব্লাঙ্ক চেক, দেড় শতাধিক সেট শাদা স্ট্যাম্প, ৫টি মোটরসাইকেল ও ১৩টি হিসাবের খাতা জব্দ করেছে পুলিশ। স্ট্যাম্প ও সই করা ব্লাঙ্ক চেক জিম্মা রেখে অবৈধভাবে সুদ কারবারের মাধ্যমে হাজারো মানুষকে নিঃস্ব করে পথে বসিয়েছে এসকল সুদ কারবারী। এমন একটি অভিযোগে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। গাংনী থানার ওসির সাহসী অভিযানকে সাধুবাদ জানিয়েছেন এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। বিগত ২৫ বছরের মধ্যে সুদখোরদের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ গাংনীর ইতিহাসে নেই বলেও মন্তব্য করেছেন অনেকে। গ্রেফতার আবু হানিফ গাংনী উত্তরপাড়ার হাজি ছমির উদ্দীনে ছেলে। গাংনী মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে মেহেরপুর-কুষ্টিয়া সড়কের পাশে ছয়তলা আলিশান বাড়ি তার। অপরদিকে একই সড়কের পল্লী বিদ্যুতের সাব স্টেশনের পাশে আনারুল ইসলামের ছয়তলা বাড়ি। গ্রেফতার হানিফের ভাই আনিছুর রহমানসহ উত্তরপাড়ার অনেক সুদ ব্যবসায়ীর কুখ্যাতি রয়েছে এলাকাজুড়ে। যারা দীর্ঘদিন ধরে এ কারবার করলেও এমন অভিযানের মুখোমুখি কখনও হয়নি। ফলে গাংনী থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাকের এই অভিযান যুগান্তকারী জনস্বার্থের অভিযান বলে সাধুবাদ জানাচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।

এদিকে অভিযান টের পেয়ে পালিয়ে গেছে গ্রেফতার আবু হানিফের ভাই আনিছুর রহমান। সুদ ব্যবসার মাধ্যমে গাংনী উত্তপাড়ায় ৬তলা আলিশান বাড়িসহ অনেক সম্পদের মালিক হয়েছে আবু হানিফ ও আনিছুর রহমান। এছাড়াও উত্তরপাড়ার সুদখোর অনেকেই এ ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। ফলে উত্তরপাড়াকে স্থানীয় মানুষ ব্যঙ্গ করে উত্তরা ব্যাংক বলে সম্বোধন করে থাকে।

যে কারণে এ অভিযান: গাংনী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম। জরুরি প্রয়োজনে তিনি আবু হানিফের কাছ থেকে এক লাখ টাকা গ্রহণ করে। টাকা ফেরতের গ্যারান্টি হিসেবে তার ব্যবহৃত একটি সুজুকি মোটর সাইকেল, ব্লাঙ্ক চেক ও শাদা স্ট্যাম্পে সই করে জমা রাখে আবু হানিফ। কিছুদিন আগে মনিরুল ইসলাম টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে জানতে পারেন তার মোটর সাইকেলটি অন্যত্র বেঁচে দিয়েছেন আবু হানিফ। এছাড়াও আবু হানিফ তাকে জানায় এক লাখ টাকায় প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা সুদ দিতে হবে। টাকা নেয়া থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তার কাছে পাওয়া হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। এই টাকার কিছু কম নিয়ে মোটর সাইকেল, গ্যারান্টি চেক ও স্ট্যাম্প ফেরত চাই মনিরুল। কিন্তু এতে মনিরুলকে মামলার ভয় দেখায় সুদখোর আবু হানিফ। বেশ কিছুদিন ধরে আবু হানিফের কাছে ধরণা দিলেও সুদখোরের পাথর মন গলেনি। ফলে অসহায় হয়ে পড়েন মনিরুল। একদিকে সুদের টাকা ফেরত অন্যদিকে মোটর সাইকেল ফেরত না পাওয়ার যন্ত্রণায় মনিরুল ইসলাম সাহসী হয়ে ওঠেন। সুদখোর আবু হানিফের মামলা ও স্থানীয় প্রভাবের তোয়াক্কা না করে তিনি গাংনী থানার ওসির কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন।

গাংনী থানার ওসি জানান, অভিযোগ পাওয়ার পর আবু হানিফের সাথে একজন অফিসারকে দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আবু হানিফ তার অবস্থানে অনড়। তাছাড়া মনিরুলের মালিকানার মোটর সাইকেল কিভাবে আবু হানিফ বিক্রি করে দিলো তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে পুলিশ। এ ঘটনায় আবু হানিফের বিষয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে খোঁজ নিতে থাকেন ওসি। তদন্তের এক পর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে ব্লাঙ্ক চেক ও শাদা স্ট্যাম্পে সই করা অনেক কিছুই তার বাড়িতে আছে। প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধানের সত্যতা নিশ্চিত হয়ে অভিযান চালায় পুলিশ।

গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় গাংনী থানা পুলিশের এসআই মাসুদুর রহমান সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে আবু হানিফের ৬তলা ভবনের সামনে অবস্থান নেয়। এসময় ৪ তলা থেকে আনারুল ইসলাম একটি ব্যাগ নিয়ে পুলিশের সামনে দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। পুলিশের এ দলটি তার ব্যাগে চেক ও স্ট্যাম্পের সন্ধান পেয়ে তাকে আটক করে।

এদিকে অভিযানের অগ্রগামী দল প্রেরণ করে ঘটনাস্থলে সঙ্গীয় ওসি (তদন্ত) মনোজিত সরকার, এসআই আতিকুর রহমানসহ  ফোর্স সঙ্গে নিয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন গাংনী থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক। আটক আনারুলের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে আবু হানিফের ৬তলা ভবনে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। ভবনে প্রবেশ করেই আটক করা হয় আবু হানিফকে।

গাংনী থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক জানান, আবু হানিফ জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে চেক ও স্ট্যাম্প রাখার কথা স্বীকার করে। এরপর বাসার বিভিন্ন স্থান থেকে একে একে বের করে দেয় কয়েক বান্ডিল চেক ও স্ট্যাম্প এবং সুদ ব্যবসার হিসেবের খাতাপত্র। প্রতিটি চেক ও স্ট্যম্পে সুদের টাকা গ্রহণকারী ব্যক্তিদের স্বাক্ষর রয়েছে। ব্লাঙ্ক চেক ও স্ট্যাম্পে সই করে নেয়ায় টাকা গ্রহণকারী অসহায় মানুষ একসময় আরও অসহায় হয়ে পড়েন।

ওসি জানান, আবু হানিফের দেয়া কাগজপত্রের মধ্যে বেশ কয়েকটি মামলার কাগজপত্র পাওয়া গেছে। চেক ডিজঅনার মামলা দেয়া হয়েছে কয়েকজনের নামে। যারা এরকম ব্ল্যাঙ্ক চেক ও শাদা স্টাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে টাকা গ্রহণ করেছিলো। দীর্ঘদিন ধরে তারা হাজার হাজার টাকা দিলেও চড়া সুদের কারণে হানিফের হিসেবের খাতা ক্লোজ হয়নি। এক পর্যায়ে ওইসব অসহায় মানুষের নামেই আদালতে মামলা করেছে আবু হানিফ।

এদিকে অভিযানে আবু হানিফের ৬তলা বাসার নিচ তলা থেকে ৫টি মোটর সাইকেল জব্দ করেছে পুলিশ। এছাড়াও নিচ তলায় হানিফের অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটি সোনার হার জব্দ করা হয়েছে। মোটর সাইকেল ও সোনার গয়না গ্যারান্টি রাখা হয়েছে টাকার বিনিময়ে।

পালিয়ে গেছে আবু হানিফের ভাই: অভিযানের আগেই বাড়ি থেকে সটকে পড়েছিলো আবু হানিফের বড় ভাই আনিছুর রহমান। এই আনিছুর রহমান ও আবু হানিফ মিলে দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে আসছে রমরমা সুদের ব্যবসা। প্রকাশ্যে তারা সুদের ব্যবসা করলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ হয় না। তাছাড়া এই সুদ কারবারীদের রয়েছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। সব মানুষকে ম্যানেজ করার মত শক্তি নিয়েই তারা ব্যবসা করে আসছিলো। ফলে তাদের বিরুদ্ধে ভুক্তভোগী কেউ অভিযোগ করার সাহস পায়নি। তবে তদন্তের মাধ্যমে সব সুদখোরদের আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন ওসি।

গ্রেফতার হওয়া দু’জনের নামের মামলার বিষয়ে গাংনী থানার ওসি আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বিপদে পড়া মানুষ তাদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে সুদের জালে আটকে যায়। টাকা নেয়ার সময় ব্লাঙ্ক চেক ও শাদা স্ট্যাম্পে সই করে নেয়া হয়। টাকা দেয়ার পর থেকে সুদ ব্যবসায়ীদের জুলুমের শিকার হন অনেকে। চড়া সুদের অর্থ আদায় করতে অনেকের নামে চেক ডিজঅনার মামলা করে ফাঁসিয়েছে গ্রেফতার সুদ ব্যবসায়ীরা। জনস্বার্থেই এসকল সুদখোরদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। তাই আবু হানিফ ও আনারুলের বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই মামলার আসামি হিসেবে তাদেরকে মেহেরপুর আদালতে সোপর্দ করা হয়। একই সাথে তদন্তের মাধ্যমে অন্যান্য সুদখোরদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে।

পুলিশের অভিযানে আত্মগোপনে অনেক সুদখোর: গাংনী সুদখোরদের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্টি হিসেবে পরিচিত আনিছুর রহমান ও আবু হানিফ। সুদের টাকা আদায়ে এলাকায় নানাভাবে পেশিশক্তির প্রয়োগও তারা করে থাকেন। এমন অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ফলে পুলিশের অভিযানে আবু হানিফ ও আনারুল ইসলাম গ্রেফতার হলে অন্যান্য সুদখোরদের মাঝে  গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে গাংনীর উত্তর পাড়াতেই গ্রেফতারকৃতদের মতো আরও কয়েকজন বড় সুদকারবারী রয়েছে। যাদের হেফাজতে রয়েছে এমন অসংখ্য ব্লাঙ্ক চেক ও সই করা শাদা স্ট্যাম্প। এক প্রকার শুন্য থেকেই অনেকে সুদের ব্যবসা করে কোটিপতি বনে গেছেন। উত্তরপাড়াতে রয়েছে আলিশান বাড়ি, গাড়ি এবং অনেক সম্পদ। তাদের মানসিক নির্যাতনে ভুক্তভোগীদের আত্মহত্যার ঘটনাও রয়েছে। এসব সুদকারবারীদের বাড়িতে আবু হানিফের বাড়ির মতো অভিযান হতে পারে এমন আশঙ্কায় চেক ও স্ট্যাম্প সরিয়ে ফেলেছেন তারা। আর অভিযানের মাঝামাঝি সময় থেকেই তারা গা ঢাকা দিয়েছেন। তবে এ সকল সুদখোরদের আইনের আওতায় আনার জন্য গতকালই অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করে দাবি জানিয়েছেন। অভিযান শেষ করে ওসি যখন ওই ভবন থেকে রাস্তায় আসেন তখন উৎসুক মানুষের অনেকেই সুদখোর বিরুদ্ধে এই সাহসী অভিযান চালিয়ে যাওয়ার জন্য ওসির কাছে অনুরোধ করেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More