দুর্গন্ধ পরিবেশের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে ওদের বসবাস
চুয়াডাঙ্গার আকন্দবাড়িয়ায় জীর্ণ আশ্রয়নে মানবতের জীবন যাপন
নজরুল ইসলাম: চুয়াডাঙ্গার আকন্দবাড়িয়ায় আশ্রয়নের ২৩টি ব্যারাকের সবগুলো ঘর জরাজীর্ণ হয়ে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। এ অবস্থাতেই সেখানে বসবাস করছেন ১শ পরিবারের তিন শতাধিক মানুষ। এদের নেই পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা। অনেকটা খোলা জায়গাতে সারতে হয় প্রকৃতির কাজ। ব্যারাক এলাকাজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে দুর্গন্ধময় পরিবেশ। আশ্রয়ণের অধিকাংশ ঘর জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে।
দীর্ঘদিন জীর্ণ অবস্থায় থাকার কারণে ঘরগুলো বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে দাবি করেছেন এখানকার বাসিন্দারা। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে আশ্রয়ণের ২৩টি ব্যারাকের ১শটি পরিবারের প্রায় তিন শতাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে।
জানা গেছে, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের ২৩ নং আকন্দবাড়িয়ায় ১নং খাস খতিয়ানের সরকারি জমিতে রজনীগন্ধা ও পারিজাত আশ্রয়ণ নামে ২৩টি ব্যারাকে গড়ে তোলা হয় টিনশেডের ঘর। সেনাবাহিনীর তত্ত¡াবধানে এ ব্যারাক নির্মাণ করা হয়। সেখানে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয় অসহায় হতদরিদ্র ১৯০টি ভ‚মি ও গৃহহীন পরিবারের। আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, তাদের পরিবারকে স্বাবলম্বী করতে নানা ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার কথা থাকলেও সেটি শুধু কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। অধিকাংশ ব্যারাকের ছাউনির টিনে মরিচা ধরে বিভিন্ন স্থানে ছোট-বড় ছিদ্র হয়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টি এলে টিনের ছিদ্র দিয়ে ঘরের ভেতরে পানি পড়ে। বৃষ্টির পানিতে ঘরের ভেতরে রাখা জিনিস ও আসবাব ভিজে যায়। অবশিষ্ট থাকে না শোবার জায়গাটাও। ঘরের জিনিসপত্র রক্ষায় চালের ফুটো বরাবর হাঁড়ি পাতিলসহ বিভিন্ন বাসন পেতে রাখতে হয়। পরবর্তীতে অবশ্য ডালিয়া গুচ্ছ গ্রাম নামে ৪০টি এবং উদয়ন নামে ৩০টি একক পরিবারের জন্য গড়ে ওঠে ৭০টি একক ঘর। আকন্দবাড়িয়ায় ২৬০টি পরিবারের জন্য গড়ে ওঠে ৯৩টি ব্যারাক। সরেজমিন দেখা গেছে, পাকা খুঁটির সিমেন্টগুলো খসে পড়ে লোহার রড বের হয়ে গেছে। বৃষ্টির পানি আটকাতে অনেকে আবার টিনের চালের ওপর টাঙিয়ে দিয়েছেন পলিথিন। পানির জন্য বসানো টিউবওয়েল এবং স্যানিটেশনের অবস্থাও বেহাল। প্রায় সবগুলো শৌচাগারই ভেঙেচুরে নষ্ট হয়ে গেছে। সেখান থেকে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। মশা মাছির উৎপাতের মধ্যে ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে আশ্রয়ণের বাসিন্দারা। রাতের আঁধারে খোলা জায়গায় সারতে হয় প্রকৃতির কাজ।
আশ্রয়নে বসবাসকারী জনাব আলী, আলেয়া, রোজিনাসহ অনেকেই জানান, এখানে বসবাসকারী সবাই দিনমজুর, কৃষিকাজ, ভ্যান, অটোরিকশা চালিয়ে সংসার চালান। অনেকের ঘরে উপার্জনক্ষম লোক না থাকায় বয়স্ক, বিধবা ভাতা ও সরকারি ত্রাণ তাদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন। এ অবস্থায় ঘূর্ণিঝড় ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে আমাদের লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়। সরকারি ঘর পেয়ে আমরা আনন্দিত হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এই ঘরে থেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে স্বাবলম্বী হবো। কিন্তু স্বাবলম্বী হওয়া তো দূরের কথা এখন আর কেউই আমাদের খোঁজ রাখেন না। আশ্রয়ণের ঘরগুলো মেরামতের জন্য বারবার কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও আজও কেউ মেরামতে এগিয়ে আসেননি। একটি সূত্র জানিয়েছে, এখানে ঘর নিয়ে কেউ অনৈতিক কমাকাণ্ডে জড়িয়ে আবার কেউ মাদকের সাথে জড়িয়ে আবাসন ছাড়া হয়েছে। কে কখন কোথা থেকে এসে এখানে বসবাস করছে তার সঠিক হিসাব কেউ রাখে না। ইউপি সদস্য আমিরুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়নে যতগুলো আশ্রয়নের ঘর আছে তা নির্মাণ এবং দেখভাল করে থাকে উপজেলা প্রশাসন। যেখানে জনপ্রতিনিধিদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। সরকারি টাকা খরচ করে গড়ে তেলা ঘরগুলো আজ বসবাসের অনুপোযোগী হয়ে পড়েছে। আবার একই নামে বিভিন্নজন একাধিক ঘর নিয়ে রেখেছে। যেখানে পালিত হয় গরু ছাগল। মানুষের সাথে পাশাপাশি ঘরে পশুর বসবাস। বেগমপুর ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা সেলিম রেজা বলেন, সরেজমিনে তদন্ত করে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং সেগুলো মেরামত করার জন্য সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট। আশা করি অতি তাড়াতাড়ি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ইউপি চেয়ারম্যান আলী হোসেন জোয়ার্দ্দার বলেন, আবাসনে গড়ে ওঠা ঘরের ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের কোনো দায়দায়িত্ব নেই। এগুলো সম্পূর্ণ তদারকি করে উপজেলা প্রশাসন। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা এনামুলের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শামীম ভূইয়া বলেন, তদন্ত করে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্ধ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ এলেই মেরামতের কাজ শুরু করা হবে। চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক আমিনুল ইসলাম খান বলেন, উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে বাস্তব চিত্র অনুসন্ধান করা হয়েছে। সে মোতাবেক বরাদ্দ পাওয়ার জন্য কাগজপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্ধ এলেই কাজ শুরু করা হবে।
উল্লেখ্য, দেশের ভ‚মিহীন-গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অন্যতম উদ্ভাবন হচ্ছে আশ্রয়ণ প্রকল্প। একটি ঘর একটি ছিন্নমূল পরিবারের দারিদ্র্য হ্রাসসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। প্রতিটি নিরাপদ গৃহ পরিবারের সকলকে করে তোলে আস্থাবান, প্রত্যয়ী এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী। মুজিববর্ষে এসে দ্রুততম সময়ে গৃহহীন ও ভ‚মিহীন মানুষকে গৃহ প্রদানের মাধ্যমে জাতির পিতা সূচিত গৃহায়ন কর্মসূচীকে তিনি নতুনরূপে উপস্থাপন করেছেন। যুগোপযোগী ও টেকসই করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নতুন ডিজাইনের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আর এসব কাজ জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে এ সকল গৃহ নির্মাণ করা হচ্ছে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে আকন্দবাড়িয়া আবাসনে বসবারত মানুষেরা মাথার ওপর ছিদ্র টিনের চাল আর দুর্গন্ধময় পরিবেশের মধ্যে মানবতের জীবন যাপন করলেও তার কোনো প্রতিকার মিলছে না।