ক্ষুধার্ত শালিকের প্রতিদিন খাবার তুলে দেন পাখিপ্রেমী রানা 

সালাউদ্দীন কাজল: ভালোবাসা হলো এক অমোঘ শক্তি। ভালোবাসা দিয়ে সব কিছু জয় করা যায়। এমনকি ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে বনের পাখিরাও ভয়কে পেছনে ফেলে মানুষের কাছে ছুটে আসে। চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে পাখির প্রতি ভালোবাসার এমনি এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন পাখিপ্রেমী মনিউর রানা। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ক্ষুধার্ত পাখিগুলো ছুটে আসে রানার কাছে। তখন রানা স্নেহ-ভালোবাসায় খাবার তুলে দেন ক্ষুধার্ত শালিক পাখিদের। এ যেনো রানা আর পাখির মধ্যে রীতিমতো প্রেম জমে উঠেছে। রানার আতিথেয়তায় তার সঙ্গে এখন দুইশ শালিকের ভাব জমেছে। রানার সঙ্গে শালিকদের এমন সখ্যতা এলাকাবাসীরও মন কেড়েছে। গত তিন বছর ধরে অসংখ্য শালিক পাখিকে খাইয়ে আসছেন রানা। করোনা মহামারির শুরু থেকে অদ্যাবধি পাখিদের খাবার দেয়া একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি। প্রথম দিকে নিয়মিত ১৫-২০টি শালিক পাখি খাবার খেতে এলেও বর্তমানে ওই শালিকের সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুইশতে।

প্রতিদিন একপ্রকার নিয়ম করেই বেলা ১১টার দিকে খাবারের জন্য শালিক পাখিগুলো জীবননগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে বৈদ্যুতিক লাইনের তার এবং দোকান ঘরের কার্নিসে সারি বেঁধে বসে কিচিরমিচির শব্দ করে ডাক শুরু করে। পাখিপ্রেমি রানা বুঝতে পারেন পাখিগুলোর ক্ষুধা পেয়েছে। এ সময় তিনি পাখিদের জন্য আগে থেকেই তৈরি করে রাখা চানাচুর, বিস্কুট, পাউরুটি, মুড়ি, আর পরোটার টুকরো ছড়িয়ে দেন তার ব্যবস্যা প্রতিষ্ঠানের সামনে। মুহূর্তেই বিদ্যুতের তার আর দোকানের কার্নিশ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে শালিক উড়ে এসে মনের আনন্দে খাবারগুলো খায়। ভালোবাসার পরশ পেয়ে পাখিগুলো নির্ভয়ে সেই খাবারগুলো খেয়ে আবার চলে যায়। দেখলে মনে হবে পাখিগুলো রানার বেশ পরিচিত ও আপন। টানা তিন বছর ধরেই তিনি নিজের উপার্জিত টাকার একটি অংশ থেকে পাখিদের খাবার খাওয়াচ্ছেন। এ যেনো মানুষ আর পাখির মধ্যে রীতিমত প্রেম। পাখি আর রানার এমন সম্পর্ক দেখতে প্রায় সময়ই ভিড় জমান এলাকাবাসী। মনিউর রানার বাড়ি চুয়াডাঙ্গার দৌলতদিয়াড়ে। তিনি ২০ বছর যাবত জীবননগর উপজেলার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে রানা এক্সরে নামে একটি প্রতিষ্ঠান চালান।

তিনি জানান, তিন বছর আগে করোনাকালীন মহামারির সময় দুপুর বেলা ৫-৭টি শালিক পাখি আমার প্রতিষ্ঠানের সামনে কিচিরমিচির শব্দ করে খাবার খুঁজে বেড়াচ্ছিলো। এসময় অমি কিছু মুড়ি এবং চানাচুর পাখিগুলোকে খেতে দিই। খাবার খেয়েই পাখিগুলো চলে যায়। এরপর আমি বাড়িতে গিয়ে রাতে শুয়ে চিন্তা করি, করোনার কারণে লকডাউনের জন্য কোনো মানুষই বাড়ি থেকে বের হচ্ছেন না। এছাড়া বাজারগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কম হওয়ায় অধিকাংশ দোকান-পাট বন্ধ। এ কারণে পাখিগুলো খাবার সঙ্কটে পড়েছে। আমি তখনই সিন্ধান্ত নিই আমার সাধ্যমতো পাখিগুলোকে খাবার দেবো। পরদিন সকালে আমি আমার প্রতিষ্ঠানে এসে কিছু চানাচুর, বিস্কুট, পাউরুটি, মুড়ি এবং হোটেল থেকে পরোটা কিনি। পরোটাগুলো টুকরো করে কেটে চানাচুর, বিস্কুট, পাউরুটি ও মুড়ির সাথে মিশিয়ে পাখিদের জন্য খাবার তৈরি করি। পরদিন খেয়াল করে দেখি একই সময় আরও অনেকগুলো শালিক পাখি এসে জড়ো হয়েছে খাবারের আশায়। খাবারগুলো দেবার পর মনের আনন্দে খেয়ে পাখিগুলো চলে যায়। সেই থেকে পাখিদের খাবার দেয়া একদিনের জন্যও থেমে থাকেনি। প্রথম দিকে ৬-৭টি পাখি এলেও দিন যতো গড়ায় ধীরে ধীরে শালিকের সংখ্যাও তত বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে শালিকগুলোর প্রতি এক ধরনের ভালোবাসা তৈরি হয় আমার। এখন তো শত শত শালিক আসে খাবার খেতে। দুটো পয়সা খরচ হলেও ওদের কলতানে যে কি আনন্দ পাই তা বলে বোঝাতে পারবো না। পাখিগুলোর কিচিরমিচির ডাক সত্যিই ভালো লাগে। এতে মনেও অনেকটা প্রশান্তি মেলে। এসব পাখিদের নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসি। যতদিন পারবো ওদের খাবার দিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবো।

তিনি আরও বলেন, কোনো কারণে দু-একদিন দোকানে বসতে না পারলে ফিরে আসার পর পাখিগুলো কিচিরমিচির শব্দ করে কাছে আসে। পরে খাবার ছিটিয়ে দিলে আপন মনে খেয়ে যার যার মতো চলে যায়।

পার্শ্ববর্তী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মাজেদুর রহমান লিটন বলেন, ভালোবাসার বিনিময়ে যে অনেক কিছু জয় করা যায় তা প্রমাণ করে দিয়েছেন রানা। ভালোবাসার বিনিময়ে পাখির সাথে তার সেতুবন্ধন তৈরি হয়েছে। দুপুরে পাখিগুলো যখন খাবার খাই তখন দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিচির মিচির শব্দ করে যা শুনে মনটা ভরে যায়। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় এভাবে সবাইকে পাখিদের পাশে দাঁড়ানো উচিত।

জীবননগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, শালিক ফসলবান্ধব পাখি। বিশেষ করে আমন মরসুমে তারা ধানক্ষেতে ক্ষতিকারক পোকামাকড় খেয়ে থাকে। এতে কৃষকদের কীটনাশক খরচ অনেকাংশে কমে যায়। এই কারণে শালিক পাখিদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। রানার মতো সবারই পাখির প্রতি মানুষের এ ধরনের ভালোবাসা থাকা উচিত। পাখি বিভিন্ন উপায়ে পরিবেশের উপকারে আসে। যার জন্য আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত পাখির প্রতি উদারতা দেখানো। অনেক সময় দেখা যায় বনাঞ্চলে নির্বিচারে গাছ কাটাসহ নানা কারণে দেশীয় পাখি বিলুপ্ত হতে চলছে। এসব পাখিদের অবাদ বিচরণ নিশ্চিত করা জরুরি।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More