দেশে চাহিদা মিটিয়ে রফতানি হচ্ছে বিদেশেও : চাঙা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি

আফজালুল হক: সারি সারি খেজুর গাছ। গাছ থেকে রস সংগ্রহে ব্যস্ত গাছিরা। সেই রস সংগ্রহ করে বাড়ির উঠানে কিংবা ফাঁকা মাঠে বড় চুলায় জ্বাল দেয়া হচ্ছে। এক থেকে দেড় ঘণ্টা জ্বাল দেয়ার পর তৈরি হচ্ছে গুড় বা পাটালি। স্বাদে অনন্য হওয়ায় চুয়াডাঙ্গার শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রেখে বাড়তি উপার্জন করছেন গাছিরা। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে চুয়াডাঙ্গায় খেজুর গুড় তৈরির ধুম পড়ে। গাছিরা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রস সংগ্রহ, জ্বাল দেয়া ও গুড় তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। জেলার খেজুর গুড় ও পাটালি মূলত স্বাদের জন্য বিখ্যাত। গুড় ও পাটালি জেলার চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হচ্ছে। এতে চাঙা হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি।
স্থানীয় গাছিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশির ভাগ গাছিরা প্রকারভেদে প্রতি খেজুর গাছ ১৫০-২০০ টাকায় শীতের তিন মাসের জন্য ক্রয় করেন। এই খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে পরিবারের সদস্যদের মাধ্যমে গুড় ও পাটালি তৈরি করেন। পরে তা বাজারে বিক্রি করে যা লাভ হয় তা দিয়ে শীতের মৌসুমে সংসার চালান।
তারা আরও জানান, মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা রসের সঙ্গে চিনি ব্যবহার করায় চুয়াডাঙ্গার শত বছরের ঐতিহ্য খেজুর গুড় সু-ঘ্রাণ ও স্বাদ হারাচ্ছে। প্রকৃত গাছিরা গুড় ও পাটালি উৎপাদনে আগ্রহ হারাচ্ছেন। পাশাপাশি ন্যায্য মূল্য হারাচ্ছেন হচ্ছে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা জেলাজুড়ে ২ লাখ ৫০ হাজার খেজুর গাছ রয়েছে। প্রতি বছর ২ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন গুড় উৎপাদন হচ্ছে। এই গুড়-পাটালি দেশের আনাচে-কানাচের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হচ্ছে।
চুয়াডাঙ্গার সদর উপজেলার বেলগাছি গ্রামের হারুনার রশীদ বলেন, আমার বাপ-দাদারা শীতের মৌসুমে খেজুর রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি বানিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেছেন। আমিও সেই ছোট্ট থেকে তাদের দেখানো পথে চলে বাড়তি উপার্জন করে আসছি। আমার ৮০-৮৪টা খেজুর গাছ আছে। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গাছ কেটে মাটির ভাড় পাতার কাজ করি। ভোরে সেই মাটির ভাড় থেকে রস সংগ্রহ করি। প্রতিটি ভাড় ১০ কেজির। এক ভাড় রস দিয়ে এক কেজি গুড় অথবা পাটালি তৈরি করা হয়। রস সংগ্রহ করে বাড়িতে কিংবা মাঠে বড় চুলায় জাল দেয়া হয়। এক থেকে দেড় ঘণ্টা জ্বাল দেয়ার পর গুড়-পাটালি তৈরি করা হয়। তবে পাটালি তৈরি করতে আরও কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হয়। তিনি বলেন, আজ ২০ বছর ধরে রস সংগ্রহ করছি। কখনও চিনিমিশ্রিত গুড় করিনি। খাটি গুড় দেখলেই বুঝতে পারবেন সহজেই। আসল খেজুর গুড় ও পাটালি কখনও চকচক করবে না। খাঁটি পাটালির রং হয় কালচে লাল। সেটা নরম ও রসালো থাকে। অনেক সময় পাটালির ওপরের অংশ কিছুটা শক্ত হতে পারে, কিন্তু ভেতরটা রসালো হয়। আর চিনিমিশ্রিত গুড়-পাটালি চকচক করে। গুড়ের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে পাটালি তৈরি করলে সেটা খুব শক্ত হয়। রসালো থাকে না। পাটালির রং কিছুটা সাদা হয়ে যায়। আমি চিনিমুক্ত গুড় ও পাটালি তৈরি করে থাকি। বর্তমান বাজার অনুযায়ী প্রতি কেজি গুড় ১৫০-১৭০ টাকা ও পাটালি ১৯০-২০০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এখন মৌসুমের শুরু তাই বেশিরভাগই বাড়িতে বিক্রি হয়ে যায়। ভরা মৌসুমে সরোজগঞ্জে ৩০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড়ের হাটে বিক্রি করে থাকি।
চুয়াডাঙ্গার বেলগাছি গ্রামের স্কুলশিক্ষক বখতিয়ার হামিদ দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, অন্যান্য জেলা থেকে চুয়াডাঙ্গার ভূমি উঁচু হওয়ার কারণে কৃষির ফলন ভালো হয়। শীত মৌসুমে খেজুর গাছ থেকে গাছিরা রস সংগ্রহ করে গুড় ও পাটালি উৎপাদন করে থাকে। এখানকার গুড় ও পাটালি অনেক সুস্বাদু এবং জনপ্রিয়। চিনিমিশ্রিত না করা এবং পরিস্কার পরিছন্ন ও কিছু কৌশল অবলম্বন করার কারণেই আজও টিকে আছে এই শত বছরের ঐতিহ্য।
চুয়াডাঙ্গা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আব্দুল মাজেদ দৈনিক মাথাভাঙ্গাকে বলেন, চুয়াডাঙ্গার খেজুর গুড় ও পাটালি স্বাদের কারণে বিখ্যাত। শীত মৌসুমে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ খেজুর রস সংগ্রহ করে বাড়িতে বাড়িতে গুড়-পাটালি উৎপাদন করে বাড়তি উপার্জন করছে। স্বাদে অনন্য এই খেজুর গুড়-পাটালি। দেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি এই গুড়-পাটালি এখন বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং গাছিদের রস সংগ্রহে প্রশিক্ষণ ও সচেতন করা হয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের নিপা ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করা হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More