কুষ্টিয়ায় হাসপাতালে আসা অধিকাংশ রোগীর অবস্থায় নাজুক

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: কুষ্টিয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে করোনা শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। এরই মধ্যে কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু জনবল সংকট ও অতিরিক্ত রোগীর চাপে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে কর্তৃপক্ষকে।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে গত ৪৮ ঘণ্টায় ৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্তমানে সেখানে ২৮৭ জন রোগী চিকিৎসাধীন আছেন। এর মধ্যে করোনা পজিটিভ রোগীর সংখ্যা ১৯৩ জন। বাকিরা করোনার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি রয়েছেন। শয্যা সংকটের কারণে অধিকাংশ রোগীর ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের বারান্দা ও মেঝেতে। এক সপ্তাহ ধরে এ হাসপাতালে প্রতি ২৪ ঘণ্টায় অন্তত ৫০ জন করে রোগী ভর্তি হচ্ছেন। হাসপাতালে চারটি আইসিইউ ও ৬টি এইচডিইউ বেড আছে। এখানেই মূলত জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হয়। এখানে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাসহ অন্যান্য আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা হয়। এই ১০টি শয্যার বাইরে অন্য রোগীদের সাধারণ বেডে হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা অথবা সিলিন্ডারে অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ আছে ৬৪টি বেডে। উচ্চমাত্রার (হাই ফ্লো) অক্সিজেন দেয়া সম্ভব ১০ জনকে।
সোমবার সকালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীর ভিড়ে হাসপাতালের কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন রোগীরা। অক্সিজেনসহ পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম থাকলেও জনবল ও জায়গার অভাব রয়েছে। এজন্য চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। জরুরি বিভাগের সামনে একটি ট্রাক থেকে কয়েকজন শ্রমিককে অক্সিজেন সিলিন্ডার নামাতে দেখা যায়। সিলিন্ডার নিয়ে তারা দ্বিতীয় তলায় উঠে যান। সেখানে ভিড় ঠেলে কোনো রকমে একটি ওয়ার্ডে প্রবেশ করেন। সেখানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা চলছে। বাইরের কাউকে সেখানে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। সিঁড়ি থেকে ওয়ার্ডের প্রবেশমুখ পর্যন্ত শতাধিক মানুষ গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওয়ার্ডের ভেতরে যেতেই চোখে পড়ল মেঝে ও বারান্দায় শুয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন অনেক রোগী। ওয়ার্ডের ভেতরে কয়েকটি কক্ষ। সব জায়গাই রোগীতে ঠাসা। কোথাও শয্যা ফাঁকা নেই। রোগী ও রোগীর স্বজনদের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা নেই। প্রায় প্রতিটি রোগীর শয্যার পাশে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা আছে। রোগীর স্বজনরা বসে বা শুয়ে আছেন রোগীর পাশেই।
চিকিৎসকরা জানান, আক্রান্ত হয়ে যারা হাসপাতালে আসছেন তাদের অধিকাংশের অবস্থাই নাজুক। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনা হয় তাদের। ততক্ষণে চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। বেশিরভাগ রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৮০র নিচে চলে যায়। এসব রোগীর মৃত্যুহার বেশি। এছাড়া যেসব রোগী ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, লিভারের রোগে আক্রান্ত তাদের অক্সিজেন লেভেল কমে যাচ্ছে। হাজারো চেষ্টা করেও তাদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তাছাড়া যারা দেরিতে চিকিৎসকের কাছে আসেন তাদের অবস্থা বেশি খারাপ হয়। সময়মতো চিকিৎসা শুরু করা গেলে অনেক রোগীকেই বাঁচানো সম্ভব হতো। যেসব রোগী মারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই অ্যাজমা, হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেশারে আক্রান্ত। রোগী ও তাদের স্বজনরা জানান, চিকিৎসক নিয়মিত তদারকি করছেন। নার্সরা সেবা দিচ্ছেন। তবে শয্যা সংকটের কারণে খুব কষ্ট হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের সংখ্যা কম। এজন্য সেবা দিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছেন। সেচ্ছাসেবীরা নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। অক্সিজেনের ঘাটতি নেই। শয্যা, নার্স, আয়া ও সুইপার সংকটে রোগীদের কষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) তাপস কুমার সরকার বলেন, অধিকাংশ রোগীকে অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। রোগীর সংখ্যা বাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে কাড়াকাড়ি লেগে যাচ্ছে। অনেকেই ৩৫ থেকে ৭০ ভাগ অক্সিজেন স্যাচুরেশন নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের অবস্থা জটিল। তাদের কমপক্ষে এক সপ্তাহের জ্বর, ঠান্ডা, কাশির ইতিহাস রয়েছে। এ রকম বেশির ভাগ রোগীই আসছেন জটিল অবস্থা নিয়ে। অক্সিজেন লেভেল কমে যাওয়ার পর যেসব রোগী আসছেন, তাদের বাঁচানো কঠিন হচ্ছে। এজন্য আগেভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে হবে। মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে। অসচেতনতার কারণে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিদিন অন্তত ৫০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন হচ্ছে। সেখানে আছে ৫৪৭টি সিলিন্ডার। এছাড়া ছয় হাজার লিটারের সেন্ট্রাল অক্সিজেন রয়েছে। সেটা দিয়ে ১০ জনকে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সাপোর্ট দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকট নেই। তবে শয্যা, নার্স, আয়া ও সুইপারের অভাব রয়েছে। দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানান, হাসপাতালে বর্তমানে শতাধিক রোগীর অক্সিজেন লেভেল ৬০ এর নিচে। তাদের উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন দেয়া দরকার। কিন্তু হাসপাতালে ১০ জনকে দেয়ার সামর্থ্য আছে। করোনা রোগীদের স্যাচুরেশন মোকাবিলা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সাত-আট দিন ভোগার পর জটিল হয়ে আসছে রোগীর অবস্থা। হাসপাতালে রোগীর চাপ ও মৃত্যুর ঘটনা আরও বাড়তে পারে। এ জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের ধরনই এমন। বেশি আক্রান্ত ও বেশি মৃত্যুর কারণ হয় করোনার এ ধরনটি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আব্দুল মোমেন বলেন, হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়া অব্যাহত আছে। প্রয়োজনের তুলনায় লোকবল কম। এজন্য চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবাই চিকিৎসা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বর্তমানে হাসপাতালে ২৮৭ জন রোগী ভর্তি আছে। প্রতিদিনই শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এভাবে বাড়তে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাবে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড হচ্ছে। সব উপজেলায় বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা। সাধারণ মানুষের অসচেতনতার কারণে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More