সলা আবাদে অভাবনীয় সাফল্য : দেশে প্রথম জিরার জাত উদ্ভাবন

দীর্ঘ গবেষণায় দেশের মাটিতে চাষ উপযোগী জাত উদ্ভাবনের অসাধ্য সাধন করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা

মাজেদুল হক মানিক : দেশে প্রতি বছর হাজার হাজার টন জিরা আমদানী করতে হয়। যার বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণও কয়েক হাজার কোটি টাকা। রসনা বিলাসের জন্য জিরা অদ্বিতীয়। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিভিন্ন প্রকার মসলা আবাদ হলেও জিরা আবাদ এতোদিন অধরাই ছিল। তবে সেই স্বপ্ন এখনে বাস্তব রুপ নিতে শুরু করেছে। দেশেই উদ্ভাবিত হয়েছে জিরার একটি জাত। যা বাংলাদেশে আবাদের বিপুল সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে আমদানী নির্ভরতা কমানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। দীর্ঘ গবেষণায় দেশের মাটিতে চাষ উপযোগী জাত উদ্ভাবনের অসাধ্য সাধন করেছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। উদ্ভাবিত নতুন জাতটি দেশের মানুষ যে জিরা রান্নায় ব্যবহার করে তার তার চেয়েও বেশি সুগন্ধীযুক্ত, বেশি স্বাদ ও অন্যান্য গুনাগণ আরও উন্নত। যাদের হাত ধরে অকল্পনীয় এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে তারা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সিটিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ, উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শ্যামল কুমার ব্র ও উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান। তাদের উদ্ভাবিত জিরার নাম দেয়া হয়েছে বারি জিরা-১। দেশের কৃষির ইতিহাসে এটি বিরাট বড় অর্জন বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

এ প্রসঙ্গে জিরার উদ্ভাবক বিজ্ঞানী মো. আব্দুল ওয়াদুদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বাংলাদেশে জিরার জাত বারি জিরা-১ নামে জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক মুক্তায়িত হওয়ার খবরটা শোনার পর আমি এতটা আনন্দিত হয়েছিলাম; আমি যখন বিএআরআই-এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসাবে চাকরীতে যোগদানের খবর পাওয়ার পর তেমন আনন্দিত হয়েছিলাম। জিরার অঙ্কুরোদগম হতে শুরু করে বপন পদ্ধতি, বপনের গভীরতা, আগাছা দমন পদ্ধতি ও সময়, সেচ প্রযোগ ও পদ্ধতি, সার প্রয়োগ, রোগ ব্যবস্থাপনা, ফসল সংগ্রহ ও সময় ইত্যাদি সকল সমস্যা নিয়ে গবেষণা করার পর বাংলাদেশ একটি সফলতার স্বপ্ন বাস্তবে দেখতে সম্মত হয়।

গবেষণার বিষয়ে তিনি বলেন, মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বগুড়ায় ২০০৮ সাল হতে জিরা নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। ২০০৮ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কখনো জিরা উৎপাদন সম্ভব হয়নি। এক কেজি জিরা বপন করে বড় জোর ১০০-১৫০ গ্রাম জিরা পাওয়া যেত। আবার কোন কোন বছর কোন ফল পাওয়া যেতই না। মূলতঃ না পাওয়ার বেদনাটাই আমাকে জিরা নিয়ে গবেষণা করার উৎসাহ জোগায়। আর আশাটাকে বাস্তবে পরিণত করতে অন্তরালে থেকে যিঁনি আমাকে অবিরামভাবে সহযোগিতা করেছেন, যিঁনি কৃষি গবেষণায় অতি পরিচিত ব্যক্তিত্ব ড. শ্যামল কুমার ব্র, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, আঞ্চলিক মসলা গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট, জয়দেবপুর গাজীপুর।

জানা গেছে, বিজ্ঞানী মো. আব্দুল ওয়াদুদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আতিকুর রহমানের তত্ত্বাবধানে জিরার রোগ, রোগের কারণ, বাংলাদেশে চাষযোগ্য জিরার জার্মপ্লাজম এবং রোগের ব্যবস্থাপনার ওপর পিএইচডি করছেন। এক্ষেত্রেও তিনি বাংলাদেশের প্রথম কোন কৃষি বিজ্ঞানী যিনি জিরার ওপরে পিএইচডি করছেন।

জানা গেছে, জাতীয় বীজ বোর্ড চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি অনিয়ন্ত্রিত জাত হিসেবে বারি জিরা-১ এর নিবন্ধন দেয়। নিবন্ধনে বলা হয়েছে, ভারতীয় জিরার জাত থেকে উদ্ভাবিত এ জাতটি ইনব্রিড। নভেম্বর মাসের প্রথম থেকে তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বীজ বপণের উপযুক্ত সময়। জীবনকাল ১০০-১১০ দিন। প্রতি হেক্টরে ফলন ৫৫০-৬০০ কেজি পর্যন্ত। চাষের জন্য সুপারিশকৃত অঞ্চল সমগ্র বাংলাদেশ।

বৃহত্তর বরেন্দ্র অঞ্চল (রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগা), বিভিন্ন চর অঞ্চল ও উত্তারঞ্চলে বারি জিরা-১ চাষের জন্য অত্যান্ত উপযোগী।  বগুড়া মসলা গবেষণা কেন্দ্রে নিরলস শ্রম আর সাধনার মাধ্যমে গবেষণায় সফলতা অর্জন করেন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ। চাষের ক্ষেত্র, মাটি, পানি, আবহাওয়া, সার ব্যবস্থাপনা, বীজ সংরক্ষণ, কীটনাশক, আগাছা দমনসহ বীজ বপণ থেকে জিরা সংগ্রহ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে কি কি করণীয় তা সুনিপূণভাবে গবেষণায় তুলে এনেছেন এই কৃষি বিজ্ঞানী।

কয়েকজন কৃষি অফিসারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমান সময়ে ফুল, ফল, সবজি ও মসলার নানা জাত রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে দ্রুত নতুন নতুন জাত আবাদ সম্প্রসারিত হচ্ছে। দেশে বিভিন্ন এলাকায় জিরা চাষের নামে ‘সলকে’ আবাদ করেন অনেক চাষি। এর অর্থ হচ্ছে চাষিরা জিরা চাষে বেশ আগ্রহী। এসব চাষিদের স্বপ্ন এবার পূরণ হবে। দেশেই যদি জিরা আবাদ করা হয় তাহলে চাষিরা অনেক লাভবান হবেন। অন্যদিকে বৈদেশিক ব্যয়ের একটি বড় অংশ সাশ্রয় হবে। আসছে নভেম্বর মাসে জিরা মরসুম শুরু হবে। এবার কৃষক পর্যায়ে আবাদের মধ্য দিয়ে জিরা চাষ দেশের তালিকায় নাম লেখাবে বাংলাদেশ। এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More