আত্মগোপনে মুরাদ এমপি পদ যাবে কি

স্টাফ রিপোর্টার: অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানোর পর আত্মগোপনে গেছেন ডা. মুরাদ হাসান। সোমবার ধানমন্ডির বাসা থেকে বেরিয়ে আর সেখানে ফেরেননি তিনি। বন্ধ রেখেছেন মোবাইল ফোনও। এদিকে জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার পর গতকাল সরিষাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে। এদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়ে দিয়েছেন, নারীর প্রতি অবমাননাকর মন্তব্যকারী নেতাকে দলে রাখবেন না তারা। এ অবস্থায় ডা. মুরাদ হাসানের সংসদ সদস্য (এমপি) পদ থাকবে কি না, এ নিয়ে আলোচনা সব মহলে। জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দল থেকে বহিষ্কার হলেই থাকবে না মুরাদের এমপি পদও। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হবে এখানে।
অন্যদিকে মুরাদ হাসানের এমপি পদে বহাল থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে। মুরাদ হাসানের সাম্প্রতিক কর্মকা- নিয়ে বিচারিক তদন্তও চাওয়া হয়েছে রিটে।
রাজধানীর ধানমন্ডির চারতলা একটি বাড়িতে নিজের দুটি ফ্লাটে সপরিবারে গত এক বছর ধরে বসবাস করছেন ডা. মুরাদ হাসান। তিনতলার একটি ফ্লাটে ছিল তার ব্যক্তিগত অফিস। প্রতিদিন অনেক নেতা-কর্মী তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। এখন সেই বাড়ির নিচে নেই দর্শনার্থীদের ভিড়। নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, সোমবার বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর আর ফিরে আসেননি। অন্যদিকে বিতর্কিত মন্তব্য ও এক চিত্রনায়িকার সঙ্গে ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর তুমুল সমালোচনার মুখে মুরাদ হাসান। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে প্রতিমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করার পর তার বাসার সামনে থেকে সরিয়ে ফেলা হয় জাতীয় পতাকাও। এখন প্রশ্ন উঠেছে, দল বহিষ্কার করলে সংসদ সদস্য পদ থাকবে কি না। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সাবেক সদস্য এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, বিএনপির মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান এবং হাসিবুর রহমান স্বপনকে নজির মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও দল থেকে বহিষ্কারের পর এমপি পদ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের মধ্যে নিজেই পদত্যাগ করেন লতিফ সিদ্দিকী। আর সপ্তম সংসদে আখতারুজ্জামান দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে সংসদে যোগ দিয়ে দল থেকে বহিষ্কার হন। পরে দলের চিঠিতে হারান এমপি পদও। সে সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে গিয়েও তার আর সংসদে ফেরা হয়নি। ১৯৯৮ সালে বিএনপি ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলে সংবিধান অনুসারে সংসদ সদস্য পদ হারান সিরাজগঞ্জ-৭ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপন।
আইনজ্ঞরা বলেন, ডা. মুরাদকে যদি দল থেকে বহিষ্কার করা হয়, তাহলে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তার সংসদ সদস্য পদ থাকবে না। এ ক্ষেত্রে স্পিকারের কাছে চিঠি লিখতে হবে আওয়ামী লীগকে। আর যদি বহিষ্কার করা না হয়, তাহলে আদালত যদি তাকে বিকৃত মস্তিষ্ক বা অপ্রকৃতিস্থ ঘোষণা করে, তাহলে সংবিধানের ৬৬ (২)ক অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এমপি পদ হারাবেন মুরাদ।
সংবিধানের ৬৬ (২)ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকবার যোগ্য হবেন না, যদি কোন উপযুক্ত আদালত তাকে অপ্রকৃতিস্থ বলে ঘোষণা করেন।’ অন্যদিকে সংবিধানের ৭০ (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি ওই দল হতে পদত্যাগ করেন; তাহলে সংসদে তার আসন শূন্য হবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোন নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ডা. মুরাদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে অওয়ামী লীগ যদি তাকে বহিষ্কার করে তাহলে তার এমপি পদ থাকবে না। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবেন স্পিকার।
জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, তিনি জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে। তাই যুক্তি হচ্ছে, দল বহিষ্কার করলে তার সংসদ সদস্য পদও থাকবে না। কারণ তিনি তখন আওয়ামী লীগের কেউ না। সে ক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ তার ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। তিনি বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদে পদত্যাগের কথা বলা হয়েছে, এ ক্ষেত্রে পদত্যাগ স্বেচ্ছায় না বহিষ্কার, তা উল্লেখ নেই। প্রয়োজনে বিষয়টি নিয়ে আরও বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব-উল-আলম বলেন, সপ্তম সংসদে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে যোগ দিয়ে এমপি পদ হারিয়েছিলেন বিএনপির আখতারুজ্জামান। তখন বিএনপি তাকে বহিষ্কার করে, পাশাপাশি স্পিকারকে চিঠি দিয়ে তার সদস্য পদ খারিজের অনুরোধ করে। দলীয় সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে এ বিএনপি নেতা যান হাই কোর্টে। ওই মামলায় হাই কোর্ট বলেছিল, যেহেতু তিনি (আখতারুজ্জামান) দল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন এবং দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে সংসদে গিয়েছেন, তাই তার সদস্য পদ বাতিল হবে।
মুরাদের এমপি চ্যালেঞ্জ করে রিট: সদ্য তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ হারানো জামালপুর-৪ আসনের এমপি মুরাদ হাসানের সাম্প্রতিক কর্মকা- নিয়ে বিচারিক তদন্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশনা চেয়ে রিট করা হয়েছে হাই কোর্টে। গতকাল হাই কোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিট আবেদন দাখিল করেন আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। এতে মুরাদ হাসানের আসন (জামালপুর-৪) শূন্য ঘোষণায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। পরে ইউনুছ আলী আকন্দ জানান, আগামী সপ্তাহে রিটের ওপর শুনানি হতে পারে।
রিটে আবেদনসূত্রে জানা গেছে, জামালপুর-৪ আসনের এমপি মুরাদ হাসানের সাম্প্রতিক কর্মকা- নিয়ে জুডিসিয়াল তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং তার আসন (জাপালপুর-৪) শূন্য ঘোষণা করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, এ বিষয়ে রুল চাওয়া হয়েছে। এছাড়া তার সাম্প্রতিক কর্মকা- ও টেলিফোন সংলাপ কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, এ বিষয়েও রুল চাওয়া হয়েছে।
২৭২ অশ্লীল অডিও-ভিডিও লিঙ্ক শনাক্ত: মুরাদ হাসানের অশালীন বক্তব্য সংবলিত ২৭২টি অডিও-ভিডিও লিঙ্ক চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশ টেলি যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন-বিটিআরসি। ফেসবুক ইতিমধ্যে বন্ধ করেছে ১৫টি। গতকাল বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চে এ প্রতিবেদন দাখিল করেছে বিটিআরসি। বিটিআরসির আইনজীবী খোন্দকার রেজা-ই রাকিবের দাখিল করা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, মুরাদ হাসানের অশ্লীল অডিও-ভিডিও লিঙ্ক ইউটিউবে চিহ্নিত করা হয়েছে ১১৫টি। এর মধ্যে মুছে ফেলা হয়েছে দুটি। ফেসবুক ও ইউটিউব থেকে অন্যান্য অশ্লীল অডিও-ভিডিও অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিটিআরসি।
এর আগে গত মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের অশ্লীল অডিও-ভিডিও অপসারণ করতে বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। একই সঙ্গে সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে অডিও-ভিডিও সরাতে কী পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে তা আদালকে জানাতে বলা হয়।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More