‘ঘরে বসে আয়’ থেকে অনলাইনে অশ্লীলতা : দেশে অনেক অপরাধে চীনের নাগরিকেরা

সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে বহু মানুষের অর্থ আত্মসাৎ

স্টাফ রিপোর্টার: ‘অনলাইনে দিনে ২০ মিনিট কাজ করে মাসে ১৮ হাজার টাকা আয় করুন’, ‘কোনো জামানত ছাড়াই ঋণ দিচ্ছি আমরা’ সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমে এমন চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে বহু মানুষের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন চীনা নাগরিকেরা। এর বাইরেও অনলাইনে নানাভাবে বাংলাদেশিদের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করছেন তারা। সাইবার অপরাধের বেশ কয়েকটি মামলা তদন্ত করে বাংলাদেশে অবস্থানরত চীনা নাগরিকদের সম্পৃক্ততা পেয়েছে পুলিশ।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, পাঁচ থেকে ছয় মাসের জন্য নতুন অ্যাপ খুলে ও ওয়েবসাইট চালু করে প্রতারণা করছেন চীনা নাগরিকেরা। এই কাজে বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি চীন থেকেও লোকজন নিয়ে আসছেন তারা।

চীনা নাগরিক ও তাদের বাংলাদেশি সহযোগীদের সাইবার অপরাধের আটটি মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে। এর পাঁচটি মামলার তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তিনটি মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এসব মামলায় বিভিন্ন সময়ে চীনের ৭ নাগরিকসহ ২০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্ত শেষে দুটি মামলার অভিযোগপত্র দিয়েছে ডিবি। তাতে তিন চীনা নাগরিককে অভিযুক্ত করা হয়েছে। বাকি তিনটি মামলার তদন্ত চলছে।

ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার আশরাফ উল্লাহ বলেন, চীনের অনেক নাগরিক বাংলাদেশে এসে বিভিন্ন ব্যবসার আড়ালে আর্থিক প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছেন। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) ইমিগ্রেশন বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, চীনা নাগরিকদের সাইবার অপরাধসহ নানা প্রতারণায় জড়িত থাকার তথ্যের ভিত্তিতে সম্প্রতি তাদের আগমনী ভিসার (অন অ্যারাইভাল ভিসা) ক্ষেত্রে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে, যা আগে অনেকটাই শিথিল ছিলো। বৈধ-অবৈধ মিলে কতজন চীনা নাগরিক বর্তমানে বাংলাদেশে বসবাস করছেন, তার সঠিক হিসেব জানা যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র বলছে, করোনাকালে দেশে ৫০ হাজারের বেশি চীনা নাগরিক ছিলেন। সেই সংখ্যাটা এখন আরও বেড়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, চীনা নাগরিকেরা মূলত পাঁচ ধরনের সাইবার অপরাধে জড়িত। এর একটি হচ্ছে মোবাইল অ্যাপভিত্তিক ক্ষুদ্র ঋণ। বিনা জামানতে ঋণ দেয়ার কথা বলে মানুষকে ফাঁদে ফেলেন। ওই অ্যাপের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য, ই-মেইল, মোবাইল নম্বরসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে নেন। এরপর কাউকে ৫ হাজার টাকা ঋণ দিয়ে ৫০ হাজার থেকে কয়েক লাখ টাকা দাবি করেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। গ্রাহক টাকা দিতে অস্বীকার করলে ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়াসহ মামলার ভয় দেখিয়ে প্রতারণা করেন তারা। ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে বসে অনেক চীনা নাগরিক ঋণ দেয়ার নামে ভারতের নাগরিকদেরও ফাঁদে ফেলছেন।

তদন্তকারীদের ভাষ্যমতে, চীনা নাগরিকেরা বিভিন্ন অ্যাপভিত্তিক অনলাইন জুয়া পরিচালনায়ও যুক্ত রয়েছেন। মূলত ক্রিকেট ও ফুটবলের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ম্যাচ ঘিরে অ্যাপগুলোতে জুয়ার আসর বসানো হয়। এছাড়া ওয়েবসাইট খুলে মাল্টি লেবেল মার্কেটিংয়ের (এমএলএম) নামেও মানুষের সঙ্গে প্রতারণায় যুক্ত তারা। চক্রের সদস্যরা পণ্য বিক্রির নামে লোকজনের কাছে লিংক পাঠান। কিছু তথ্য দিয়ে সেই লিংকে প্রবেশের পর পণ্য কেনা ও অল্প টাকা বিনিয়োগে অনেক টাকা আয়ের প্রলোভন দেখিয়ে পাঁচ শ থেকে পাঁচ হাজার টাকা নেয়া হয়। ওই ব্যক্তিকে পাঁচজন বিনিয়োগকারী আনতে পারলে লভ্যাংশ দেয়ার কথা বলা হয়। পরে বিনিয়োগকারী আনলেও তাঁকে আর টাকা দেয়া হয় না। চীনা নাগরিকদের প্রতারণার আরেক কৌশল হচ্ছে, বিভিন্ন নামীদামি প্রতিষ্ঠানের আদলে ওয়েবসাইট খুলে ঘরে বসে টাকা আয় করার বিজ্ঞাপন প্রচার। তাদের আরেক অপরাধ হলো, অনলাইনে লাইকি ও বিভো অ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্মে অশ্লীলতা ছড়িয়ে অর্থ নেয়া। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছেন তারা। বিগো অ্যাপের লাইভ ভিডিওর মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়ানোর অভিযোগে গত বছরের জুন মাসে চীনা নাগরিক ইয়াও জিসহ পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়। তদন্ত সংস্থা সিআইডি বলছে, এই অ্যাপের মাধ্যমে অশ্লীলতা ছড়িয়ে বাংলাদেশিদের কাছ থেকে ১০৮ কোটি টাকা নেয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় বিগো বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াও জির বিরুদ্ধে ৭৯ কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এগুলোর বাইরে এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা উত্তোলনসহ অন্যান্য প্রতারণায়ও চীনা নাগরিকদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। গত নভেম্বরে চীন থেকে পণ্য আনার নামে এক চীনা নাগরিকের কাছ থেকে  ৫০ লাখ টাকা নেয়ার চেষ্টা করে একটি চক্র। এ ঘটনায় চার চীনা নাগরিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। একজন দোভাষীর মাধ্যমে কয়েকটি প্রতারক চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা গেছে, ব্যবসার কথা বলে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স ও বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) থেকে অনুমতি নিচ্ছেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। পরে ওই প্রতিষ্ঠানের আড়ালে প্রতারণা করছেন তারা। প্রতারক চক্রের এক সদস্য জানান, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি দেয়ার নামে চীন থেকে অনেককে বাংলাদেশে আনা হয়। পরে তাদের দিয়ে প্রতারণার কাজ করানো হয়। যারা চক্রের শর্ত অনুযায়ী কাজ করেন, তাদের ভালো বেতন দেয়া হয়। কেউ তাতে রাজি না হলে ওই চীনা নাগরিককে জিম্মি করে তার পরিবারের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করা হয়।

ডিবির তথ্য বলছে, অনলাইনে পণ্য বেচাকেনার প্ল্যাটফর্ম অ্যামাজনের আদলে ওয়েবসাইট খুলে চটকদার বিজ্ঞাপন প্রচার করে বহু মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে আসছিলো একটি চক্র। সম্প্রতি দুই চীনা নাগরিকসহ চক্রের চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার কয়েক হাজার নম্বর উদ্ধার করা হয়। লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ডিবি বলছে, গত তিন মাসে প্রতারণার মাধ্যমে অবৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে (হুন্ডি) প্রায় এক শ কোটি টাকা পাচার করেছে চক্রটি। সম্প্রতি চীনা প্রতারক চক্রের বিরুদ্ধে একটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠানের করা একটি মামলা তদন্ত করছে সিআইডির সাইবার মনিটরিং স্টেশন। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এমএলএমের নামে ভার্চ্যুয়ালি পণ্য বিক্রি করে অনেকের সঙ্গে প্রতারণা করছে চক্রটি। টাকা লেনদেনের জন্য একটি মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠানের মার্চেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তারা। তদন্তে দেখা গেছে, ওই অ্যাকাউন্টটি একজন মৃত ব্যক্তির নামে। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তাকে অবৈধ সুবিধা দিয়ে চীনা নাগরিক অ্যাকাউন্টটি খোলেন। ওই অ্যাকাউন্টের লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিআইডি বলছে, ৭ দিনে প্রায় ১৪ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। পরে এই টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More