টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছে বাংলাদেশ

স্টাফ রিপোর্টার: করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে টিকা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বিকল্প নেই। আর টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বড় সুযোগ পেয়েও হাতছাড়া করেছে বাংলাদেশ। গত বছরের নভেম্বরে চীনের ২২ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বাংলাদেশ সফরে আসেন। তারা এদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে চীনের টিকা বাংলাদেশের উৎপাদনে সার্বিক সহযোগিতা করতে চেয়েছিলেন। বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিল চীনের বিশেষজ্ঞ টিমের প্রস্তাবে অনুমোদনও দিয়েছিলো। কিন্তু রহস্যজনক কারণে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তা আর গুরুত্ব পায়নি। এ নিয়ে দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক ভুলের মাশুল পুরো জাতিকে দেয়া লাগবে। হাতের কাছে সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি বাংলাদেশ। ওই সময় চীনের প্রস্তাব মেনে নেয়া উচিত ছিল। তাহলে দেশের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ মানুষ এতোদিন করোনার টিকার আওতায় চলে আসতো। দেশের অর্থনীতির চাকাও আরো এগিয়ে যেতো। স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হতো। চীনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ করে ইতালি, ব্রাজিলসহ বিশ্বের ৬০টি দেশ করোনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আমরা কেন এই সুযোগ হাতছাড়া করলাম?
বিশেষজ্ঞদের মতে, যখন কোন মহামারী আসে তখন কী কী অতীব প্রয়োজন তা আগে শনাক্ত করতে হয়। এক্ষেত্রে বিচক্ষণ ও বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। করোনা মহামারীর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি ছিল টিকা। মহামারীর সময় বিশ্বের কোন দেশই নিরাপদ থাকতে পারে না। সেই সময় মহামারী নিয়ন্ত্রণে যে সহযোগিতা করবে সেই দেশও মহামারী ঝুঁকিতে। ওই সময় কোন দেশের দিকে না তাকিয়ে মহামারী নিয়ন্ত্রণে টিকাসহ যে ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে সেটিকেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করা উচিত। টিকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এই ধরনের সহযোগিতা গ্রহণ করলে বর্তমানে করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকতো বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। করোনা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে টিকাপ্রাপ্তিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, হাসপাতাল বাড়িয়ে কোনো লাভ হবে না। কারণ রাতারাতি ডাক্তার বানানো যাবে না। অভিজ্ঞ জনবল না থাকলে হাসপাতাল বাড়িয়েও চিকিৎসা সেবা দো যাবে না। যখন সংক্রমণ ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়বে, তখন চিকিৎসার অভাবে অনেকে মারা যাবে। করোনা মহামারী মোকাবেলায় দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। এক. স্বাস্থ্যবিধি মানা দুই. ভ্যাকসিন। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে গাফিলতি তো রয়েছেই। করোনা ভাইরাসের টিকার ক্ষেত্রেও একমুখী সিদ্ধান্তের কারণে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। প্রথম দিকে বাংলাদেশ শুধু অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা পাওয়াকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলো। অন্য টিকা সংগ্রহ কিংবা কোনো টিকা উৎপাদনে আগ্রহ ছিলো না। অনেকে মনে করেছিলো, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে সব টিকা পাওয়া যাবে। অথচ যারা টিকা উৎপাদন করছে প্রথম থেকেই তাদের সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা উচিত ছিলো। মহামারীর প্রথম ঢেউ সামাল দেয়ার মধ্যেই গত বছরের নভেম্বরে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার তৈরি তিন কোটি ডোজ করোনাভাইরাসের টিকা কিনতে চুক্তি করে বাংলাদেশ। দুই চালানে সেরাম ইনস্টিটিউট ৭০ লাখ ডোজ টিকা পাঠানোর পর ভারত সরকার রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশ বেকায়দায় পড়ে। দ্বিতীয় ডোজ দিতে কমপক্ষে ২০ লাখ ডোজ টিকার জন্য বাংলাদেশ ভারতের কাছে অনুরোধ জানায়। কিন্তু ভারত তাতে অপরাগতা জানিয়েছে। পরে যখন চীনের ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হলো বাংলাদেশের, তখন চীনের কাছ থেকে ভ্যাকসিন পাওয়ার তালিকায় বাংলাদেশের স্থান ৬০ দেশের নিচে নেমে আসে। চলতি জুন মাসে দেড় কোটি ডোজ চীনা টিকা দেশে আসার কথা ছিল। সিনোফার্ম থেকে মোট দেড় কোটি টিকা আনার জন্য দেশটির কাছে ক্রয় প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ। বাণিজ্যিক চুক্তির আওতায় এই টিকা বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। তবে গোপনীয়তার শর্ত ভেঙে দাম প্রকাশ করায় চীন থেকে টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। চীন প্রতি ডোজ টিকা ১০ ডলারে বাংলাদেশকে দিতে চেয়েছিল। তবে শ্রীলংকায় ১৫ ডলার ও ইন্দোনেশিয়ায় ১৭ ডলারে টিকা বিক্রি করছে চীন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, চুক্তি গোপনীয়তা কেন বজায় রাখতে পারলো না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? এটা তাদের চরম ব্যর্থতার পরিচয়। যারা গোপনীয়তা রক্ষা করতে পারে না, তাদের দিয়ে কিছুই হবে না। টিকা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বর্তমানে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে তা নিরসন করা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপেই সম্ভব বলে মত দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তা ও দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনেক কর্মকর্তা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না। অধিকাংশ কর্মকর্তা নিজেদের লাভ ছাড়া আর কিছুই বোঝেন না। মহামারীর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমলাতন্ত্রকে গুরুত্ব দেয়ার সুযোগ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, করোনার ভাইরাসের টিকা দ্রুত পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করা হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, করোনা সংক্রমণ রোধ করতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি জনগণকে টিকার আওতায় আনতে হবে। চীনের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা সৃষ্টির মূল কারণ গোপন চুক্তি প্রকাশ করা। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর চরম মূল্য দিতে হবে। স্বাস্থ্য বাজেটে কোথায় কী ব্যয় ধরা হয়েছে তা ঘোষণা করার দাবি জানান তিনি। করোনা মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য ও স্বাধীনতা চিকিত্সক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, করোনা প্রতিরোধের দুইটি পথ হলো, স্বাস্থ্যবিধি মানা ও টিকা প্রদান। আগে থেকেই টিকায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। চীনের ভ্যাকসিন দেশে উৎপাদন হলে টিকার সমস্যা থাকতো না। তিনি বলেন, টিকা সংকট নিরসনে প্রধানমন্ত্রী যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তাতে হয়তো দ্রুত সংকট কেটে যাবে। রাশিয়ার টিকা দেশে প্রয়োগের চিন্তা-ভাবনা চলছে। সোসাইটি অব মেডিসিনের সাধারণ সম্পাদক মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর বলেন, করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণ করতে টিকার কোন বিকল্প নেই। বর্তমানে ভারত বিভিন্ন দেশ থেকে টিকা আনছে। বিশেষ করে যে টিকা এখন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে, ভারত সেগুলো বেশি আমদানি করছে। বাংলাদেশেরও একই পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, টিকার মাধ্যমেই করোনা দূর করতে হবে। এ জন্য আমাদের সক্ষমতা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। দেশে টিকাদান শুরু হওয়ার পর থেকে হিসাব করলে দেখা যায় যে, প্রতিদিন গড়ে এক লাখ করেও টিকা দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই টিকা দেয়ার গতি বাড়াতে হবে। দেশের ১২ কোটি মানুষকে টিকা দিতে হলে প্রতিদিন কমপক্ষে ১৫ লাখ থেকে ১০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More