বাংলাদেশি তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতন : ভারতজুড়ে তোলপাড়

গুলিবিদ্ধ অবস্থায় টিকটক হৃদয়সহ ছয়জন আটক : বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশের পুরস্কার ঘোষণা
স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশি এক তরুণীকে ভারতের কেরালায় নিয়ে পৈশাচিক নির্যাতনের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর তোলপাড় শুরু হয়েছে। নেট দুনিয়ায় গ্যাং রেপ ও নির্যাতনের বিভৎস দৃশ্য ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয় পুলিশের তৎপরতা শুরু হয়। নির্যাতনকারীদের গ্রেফতারে রাজ্যে রাজ্যে পুলিশ পুরস্কার ঘোষণা করে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজিও নির্যাতনকারীদের শয়তান আখ্যা দিয়ে টুইটে বলেছেন, যে কোনো মূল্যেই এদের গ্রেফতার করা হবে। পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশও ভিডিওর ক্লিপ দেখে নির্যাতিত তরুণী ও নির্যাতনকারীদের শনাক্তে মাঠে নামে। নেট দুনিয়ায় ভাইরাল ভিডিওটি জনমনে ক্ষোভ ছড়ানোর মধ্যেই গতকাল ভোরে নির্যাতনকারী দুই নারীসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করে বেঙ্গালুরু থানা পুলিশ। গ্রেফতার সবাই বাংলাদেশি। নির্যাতিত তরুণীর খোঁজ করছে পুলিশ।
নির্যাতনকারীদের মূল হোতা হলেন ইউটিউবের ঢাকার টিকটকার রিদয় বাবু। গ্রেফতারের পর তাদের নির্যাতনের ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হলে ছয়জনের মধ্যে দুজন পুলিশকে ধাক্কা দিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। এসময় পুলিশ গুলি চালালে হৃদয় বাবু এবং সাগর গুলিবিদ্ধ হয়। অপর গ্রেফতারকৃতরা হলেন মোহাম্মদ বাবা শেখ ও অখিল। নারী দুজনের নাম প্রকাশ করেনি বেঙ্গালুরু পুলিশ। ভারতের একাধিক গণমাধ্যমে এ খবর প্রকাশ পেয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পুলিশকেও গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বেঙ্গালুরু পুলিশ। গ্রেফতারের পর বেঙ্গালুরু পুলিশ কমিশনার কমল পন্ত জানান, আপাতত যা তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে করা হচ্ছে অভিযুক্তরা একই দলের সদস্য। টাকা নিয়ে ঝামেলার কারণে নির্যাতিতার ওপর অত্যাচার চালিয়েছে অভিযুক্তরা। মেয়েটিকে পাচারের জন্য ভারতে নিয়ে আসা হয়েছিলো। বর্তমানে শীর্ষ কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে তদন্ত চলছে। ভাইরাল ভিডিওতে দেখা গিয়েছিলো, দুই মহিলা ও চার যুবক এক তরুণীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে। নির্যাতিতাকে গণধর্ষণ, মারধরের পাশাপাশি তার যৌনাঙ্গে বোতলও ঢুকিয়ে দেয়।
বাংলাদেশ পুলিশ বলছে, পাচারের জন্য তরুণীকে ভারতে নেয়া হয়েছিলো। পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহিদুল্লাহ বলেন, কেরালা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই ঘটনায় ছয়জনকে আটকের বিষয়ে জানতে পেরেছি। আটকদের মধ্যে এক যুবকের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। হৃদয় বাবু ওরফে টিকটক বাবু নামের ওই যুবক ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা। গ্রেফতার টিকটক হৃদয়কে দ্রুত দেশে ফেরত আনার প্রক্রিয়াও শুরু করার কথা জানিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ ঘটনায় দুই দেশেই মামলা ও তদন্ত চলবে বলেও জানিয়েছেন তারা। পুলিশ সদর দফতরের এনসিবির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা- ইন্টারপোলের লিংকআপে থাকা এনসিবি ঢাকা যোগাযোগ রক্ষা করে বিদেশে থাকা আসামিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে থাকে। তবে কেরালায় নির্যাতনের ঘটনায় টিকটক হৃদয়সহ অন্য আসামিদের বিষয়ে দিল্লির এনসিবি আমাদের আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। আমরাই তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’
তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার মো. শহীদুল্লাহ জানান, অভিযুক্ত যুবক রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা। কয়েক দিন ধরে ভারতে ধারণ করা একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ভিডিওটি আমাদের নজরে আসে। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, ২০-২২ বছরের একজন তরুণীকে বিবস্ত্র করে ৩/৪ জন যুবক শারীরিক ও বিকৃতভাবে যৌন নির্যাতন করছে। ভিডিওটির একজনের সঙ্গে বাংলাদেশি একটি ছেলের ছবি মিলে যায়। এরপরই এ বিষয়ে আমরা তদন্ত শুরু করি। তদন্তের একপর্যায়ে জানা যায়, নির্যাতনকারী ওই যুবকের নাম রিফাতুল ইসলাম হৃদয়। সে রাজধানীর মগবাজার এলাকার বাসিন্দা। রিফাতুল ইসলাম হৃদয়ের পরিচয় তার মা ও মামার কাছ থেকে শনাক্ত করা হয়। এলাকায় সে টিকটক হৃদয় বাবু নামে পরিচিত।
উপ-কমিশনার বলেন, এ বিষয়ে হৃদয়ের মা ও মামাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে তারা জানান, উচ্ছৃঙ্খল কর্মকা-ের কারণে চার মাস আগে হৃদয়কে বাসা থেকে বের করে দেয়া হয়। বাসার কারও সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই। তদন্তের একপর্যায়ে হৃদয়ের মামার হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে তার ভারতীয় নম্বরে যোগাযোগ করা হয়। হৃদয় জানায়, তিন মাস আগে সে ভারতে গেছে। যৌন নির্যাতনের যে ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেই ঘটনা ১৫ থেকে ১৬ দিন আগেকার। হৃদয় ফোনে তার মামাকে আরও জানায়, ওই তরুণী বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা। সে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় থাকতো। ওই তরুণীর আরও পরিচয় জানতে চাওয়া হলে হৃদয় হোয়াটসঅ্যাপে ভিকটিমের একটি ভারতীয় পরিচয়পত্র আধার কার্ড পাঠায়। যৌন নির্যাতনের ঘটনায় হৃদয় ও তার কয়েকজন বন্ধু জড়িত ছিলো। এটি ঘটে ভারতের কেরালায়।
যেভাবে গ্রেফতার: বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশের এক প্রেসনোটে জানানো হয়, ভিডিও ক্লিপস দেখে ঘটনায় জড়িত এক নারীসহ পাঁচজনকে দ্রুত শনাক্ত করে আটক করা হয়। এরপর ভিডিও ক্লিপ এবং আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যের ভিত্তিতে রামমূর্তি নগর থানায় তাদের বিরুদ্ধে ধর্ষণ, নিপীড়ন ও এ সংশ্লিষ্ট আইনের অন্যান্য ধারায় মামলা করা হয়। ধারণা করা হয়, তারা সবাই বাংলাদেশি। চক্রটি ওই তরুণীকে নির্যাতনের সময় ভিডিও ধারণ এবং ক্লিপ আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করে। ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পরপরই নর্থ ইস্ট পুলিশ ও বাংলাদেশ পুলিশ তদন্ত শুরু করে। অভিযুক্তদের তথ্য পেতে আসাম পুলিশ তাদের ছবিও আপ করে টুইটারে। এরই একপর্যায়ে বেঙ্গালুরুর একটি সেল ফোন থেকে ভিডিওটি ছড়ানোর বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপর বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশকে সতর্ক করা হয় এবং একটি বিশেষ দল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাদের শনাক্ত করে। তাদের গ্রেফতার করা হয় একটি ভাড়া বাসা থেকে। পরে শুক্রবার সকালে গ্রেফতার চারজনকে বেঙ্গালুরুর চান্নাসান্দ্রের কারেগোড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়, যেখানে অপরাধীরা বাসা ভাড়া নিয়েছিলো। ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পর চারজনের মধ্যে দুজন পুলিশের ওপর আক্রমণ চালিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে ‘ওপেন ফায়ার’ করে। পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থলে পৌঁছার পর দুজন মিলে আক্রমণের শুরুতে পুলিশ সদস্যদের হাঁটুতে সজোরে লাথি মেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর আগে নাগাল্যান্ড ও আসাম পুলিশ আসামিদের গ্রেফতারে পুরস্কার ঘোষণা করে।
বিক্রি হয়েছিলো তরুণী: তরুণী কোথায় ছিলো, কীভাবে ভারত গেলো এ বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সূত্র জানায়, ভারতের কেরালায় নৃশংস যৌন নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি সেই তরুণীকে আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন মগবাজারের রিফাদুল হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয়। পরবর্তীতে পতিতালয়ের অন্ধকার জগতে নামতে বাধ্য করতে মেয়েটির ওপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা, মেয়েটির স্বজন ও বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশ সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তারা জানান, ঢাকার মগবাজার থেকে প্রায় ১৫ মাস আগে ২২ বছর বয়সী ওই তরুণী নিখোঁজ হন। তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করে কোনো সন্ধান পাননি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সম্প্রতি এক তরুণীর ওপর নৃশংস নির্যাতনের ভাইরাল হওয়া ভিডিওর সূত্র ধরে তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ তরুণীকে শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। উদঘাটন করা হয় নির্যাতনকারী বাংলাদেশি যুবকের পরিচয়। খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার ভারতের বেঙ্গালুরু সিটি পুলিশ বেঙ্গালুরুর বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশি নাগরিক টিকটক হৃদয়সহ আরও চারজনকে গ্রেফতার করে। ভারতীয় পুলিশের বরাতে গ্রেফতারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মো. শহিদুল্লাহ। তিনি জানান, মেয়েটিকে দুবাইয়ে চাকরি দেয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করা হয়। এই পাচারে বাংলাদেশ ও ভারতের সংঘবদ্ধ চক্র রয়েছে, যাদের অধিকাংশই ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। এখন হাতিরঝিল থানায় মেয়েটির বাবার করা মামলার তদন্তের স্বার্থে গ্রেফতার হওয়া সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
মেয়েটির স্বজনরা জানান, প্রায় চার বছর ধরে তরুণীর বাবা মগবাজার ফুটপাথে জুসের ব্যবসা করেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলের মধ্যে ভিকটিম মেয়েটি সবার বড়। প্রায় ছয় বছর আগে চাঁদপুরের এক ছেলের সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে হয়। পরবর্তীতে তাদের ঘরে এক মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়। বছর তিনেক আগে মেয়েটির স্বামী কুয়েত চলে যান। এরপরই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সঙ্গে মেয়েটির কলহ শুরু হয়। কথায় কথায় নির্যাতনের শিকার হন। বছর দেড়েক আগে শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সইতে না পেরে বাবার কাছে চলে আসেন।
এসময় মগবাজারের রিফাদুল হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবুর নজরে পড়েন। তারই প্ররোচনা ও প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে দুবাই যাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির নিগ্রহের কারণে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ খুঁজতে থাকেন। মেয়েটির বাবা বলেন, ‘মেয়ে আমাকে বলেছিলো, হৃদয়ের দুবাই পাঠানোর লাইন আছে। তার মাধ্যমে সে চাকরির জন্য যেতে চায়। আমি নিষেধ করেছিলাম। এর কয়েক দিন পর মেয়েটি নিখোঁজ হয়ে যায়।’ তেজগাঁও বিভাগের আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ভারতের কেরালায় বাংলাদেশি তরুণীর ওপর নৃশংস যৌন সহিংসতার ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর বাংলাদেশ ও ভারতের পুলিশ ঘটনার তদন্তে তৎপর হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ভিকটিম ও নির্যাতনকারীদের শনাক্ত এবং গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়। এখন অধিকতর তদন্তে প্রকৃত বিষয় উদঘাটন করা হবে। কারা, কী উদ্দেশে পাচার করছিলো, কেন নির্যাতন করেছিলো সবই জানার চেষ্টা চলছে। বৃহস্পতিবার রাতে হাতিরঝিল থানায় মেয়েটির বাবা নারী নির্যাতন ও পর্নোগ্রাফি আইনের মামলার এজাহারে উল্লেখ করে বলেন, ‘মগবাজারের রিফাদুল ইসলাম হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় বাবু আমার মেয়েকে ফুঁসলিয়ে দুবাই নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করে।’ এজাহারে মেয়েটির বাবা আরও বলেন, ‘ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে আমার মেয়েকে চিনতে পেরেছি। সেখানে দেখা গেছে, হৃদয়সহ অজ্ঞাতনামা এক মহিলা ও তিন পুরুষ মিলে আমার মেয়েকে বিবস্ত্র করে শারীরিক আঘাত ও যৌন নিপীড়ন করে। এ সময় আমার মেয়ে চিৎকার করছে আর আসামিরা উচ্চৈঃস্বরে গান বাজিয়ে আনন্দ করছে।’

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More