বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তদের আগুন : নিহত অন্তত ৪

স্টাফ রিপোর্টার: বিএনপি ও দলটির সঙ্গে যুক্ত আন্দোলনে থাকা দলগুলোর ডাকা ৪৮ ঘণ্টার হরতালের আগের রাতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোট ঠেকাতে ও অস্থিরতা সৃষ্টি করতে রাজধানীর গোপীবাগে গতকাল শুক্রবার রাতে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এই ঘটনায় অন্তত চারজন নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত। এ দগ্ধ হওয়ার খবর জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা। ফায়ার সার্ভিসের আটটি ইউনিট প্রায় দুই ঘণ্টা কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। রাত ৯টা ৫ মিনিটের দিকে ট্রেনের পাওয়ার কারে আগুন লাগে বলে জানা গেছে। পরে চারটি বগিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার তথ্য পাওয়া যায়। বেনাপোল থেকে যাত্রী নিয়ে ট্রেনটি পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলো। কমলাপুর রেলস্টেশনে পৌঁছনোর কিছুক্ষণ আগে গোপীবাগ কাঁচাবাজারের সামনে ট্রেনে আগুন লাগে। বিষয়টি নিশ্চিত করে ফায়ার সার্ভিসের ডিউটি অফিসার রাকিবুল হাসান বলেন-রাত ৯টা ৫ মিনিটে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। রাত ৯টা ২৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ১০টা ১০ মিনিটের দিকে আগুনের মাত্রা যখন কমে আসে তখন ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারীদল ট্রেনের ভেতরে প্রবেশ করে। পরে ১০টা ২০ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে ডিএমপি, রেলওয়ে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও আনসার সদস্যরা সমন্বিতভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধারে কাজ করে। এ ঘটনায় চার জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী। ঘটনার পর পরই সেখানে উপস্থিত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। র‌্যাব, পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা পুরো এলাকা নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ ঘটনায় এক চিকিৎসকসহ তিন দগ্ধ যাত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তারা হলেন ডা. কৌশিক বিশ্বাস (৩৫), আসিফ মো. খান (৩০) ও নাফিস আলম (২২)। বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন জানান, এখন পর্যন্ত তিনজন ভর্তি আছেন। তাদের বার্ন অল্প হলেও শ্বাসনালী পুড়ে গেছে। তারা ঝুঁকিমুক্ত নন। আমরা চিকিৎসা দিচ্ছি। ঘটনাস্থল থেকে আরও আহত রোগী আসতে পারে বলে ধারণা করছি। আমরা প্রস্তুত আছি চিকিৎসার জন্য। পুড়ে যাওয়া পাঁচটি বগিই ছিলো এসি কার। বগিগুলোর জানালা বন্ধ থাকায় হতাহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন উদ্ধারকারীরা। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী জানান, তিনি যে বগিতে উদ্ধারকাজে অংশ নিয়েছেন ওই বগির দুই পাশে দরজার কাছে অনেক আহত মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেছেন। তার ধারণা এসি বগি হওয়ায় জানালা খুলতে না পেরে দরজার কাছে হুড়োহুড়ি করে যাত্রীরা আহত হয়েছেন এবং ধোঁয়ায় অনেকে অজ্ঞান হয়ে সেখানেই পড়ে ছিলেন। পৌনে ১০টার দিকে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ট্রেনের কয়েকটি বগিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে এলাকাবাসী যে যার মতো করে পানি দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেছে। রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঘটনাস্থল থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, এ অগ্নিকা-ের ঘটনা যে নাশকতা সেটি স্পষ্ট। এটা ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। যারা এটি করেছে তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা হবে। কারণ এ ধরনের ঘটনা অমানবিক, সহিংসতায় আগুনে পুড়ে মারার ঘটনা কোনো মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। যারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের শিগগিরই খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। তদন্ত শুরু হয়েছে। এদিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এ ঘটনায় চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আগুনের সূত্রপাত কিভাবে এবং ক্ষয়ক্ষতি ও আহত-দগ্ধের সংখ্যা বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষ জানা যাবে। আগুনে চারটি বগি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কথা জানিয়ে রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা বিভাগীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের অপারেটর মোখলেছুর রহমান বলেন, ‘সায়দাবাদ এলাকা অতিক্রমকালে বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘চ’ বগিতে প্রথমে আগুন দেখা যায়। এরপর পাওয়ার কার এবং আরও দুটি বগিতে আগুন ছড়িয়ে যায়।’ র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন রাত সাড়ে ১০টায় ঘটনাস্থলে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা আনুমানিক সোয়া ৯টার দিকে জানতে পারি আগুন লেগেছে। দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে না কি নাশকতাকারীরা দিয়েছে, না কি অন্য কোনোভাবে আগুন লেগেছে, তা আমাদের গোয়েন্দারা তদন্ত করছেন। ট্রেনের চালকসহ ট্রেনে থাকা যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা করছি, কিভাবে আগুনটি লেগেছে।’ তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী জানিয়েছে, দুইজনকে সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া ট্রেনের আলামত সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিস্তারিত বলা যাবে। রেলওয়ে পুলিশের ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন বলেন, এটি নাশকতা নাকি ট্রেনে গোলযোগ, বিষয়টি যাচাই করা হচ্ছে। ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. বাচ্চু মিয়া বলেন, দগ্ধ আসিফ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। ছেলে বের হতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি এমনটি জানান দগ্ধ আসিফের বাবা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান। তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা জেলায়। বর্তমানে তারা ৭৬ শরৎ গুপ্ত রোড গেন্ডারিয়ার নারিন্দায় থাকেন। সিদ্দিক খান জানান, আসিফ ও তার স্ত্রী নাতাশা ফরিদপুরের ভাঙ্গায় আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে ফেরার পথে এ ঘটনার শিকার হন। আগুন লাগার পর তারা দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে ছেলে জানালা দিয়ে মাথা বের করেন। সে সময়ে লোকজন তাকে টেনে বের করতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, নাতাশা ট্রেনে রয়ে গেছে। এদিকে এ অগ্নিকা-ের ঘটনায় ঢাকা থেকে ট্রেন চলাচলে বিঘœ ঘটে। এতে অনেক যাত্রী ভোগান্তিতে পড়েছে বলে জানা গেছে। এ অগ্নিকা-ে হতাহতের সংবাদে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. নূরুল ইসলাম সুজন। এক শোকবার্তায় অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় নিহতদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেছেন। এ ছাড়া শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী। একই সঙ্গে অগ্নিকা-ের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীদের জঘন্যতম কর্মকা-ের নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। এর আগে, ১৯ ডিসেম্বর ভোরে ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তের দেয়া আগুনে এক নারী ও তার শিশু সন্তানসহ চার যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More