সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন : দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণ কাল

কেন্দ্রে ব্যালট পেপার যাবে সকালে : ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
স্টাফ রিপোর্টার: বিরোধপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আগামীকাল রোববার সারাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত একটানা ভোটগ্রহণ করা হবে। ভোট নিয়ে উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠারও কমতি নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইতিমধ্যেই নির্বাচনি সহিংসতায় কমপক্ষে পাঁচজনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এখন কেবল ভোটের জন্য অপেক্ষা। তার আগে নির্বাচনকে সামনে রেখে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টায় শেষ হয়েছে প্রার্থীদের আনুষ্ঠানিক প্রচার-প্রচারণা। ইসির নিয়মানুযায়ী, ভোটের ৪৮ ঘণ্টা আগে শেষ করতে হয় প্রচার-প্রচারণা। তারপরও নানাভাবে অনানুষ্ঠানিক প্রচারণা এবং পোলিং এজেন্ট চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন প্রার্থীরা। নির্বাচন উপলক্ষ্যে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে ভোটকেন্দ্র, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ভবনের নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘প্রায় ৮ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ভোটগ্রহণ করবেন। আরো ১ লাখ স্ট্যান্ডবাই থাকবেন। আমাদের ৯ লাখ জনবল প্রস্তুত আছে। আর আনসার-ভিডিপি, র‌্যাব, বিজিবি সব মিলিয়ে সাড়ে ৭ লাখ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঠে আছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য প্রায় ৩ হাজার ম্যাজিস্ট্রেট ও জাজেস মাঠে আছেন। পাশাপাশি বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তার জন্য সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরাও মাঠে রয়েছেন।
প্রসঙ্গত, গত ১৫ নভেম্বর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে সিইসি ৩০০ আসনের তপশিল ঘোষণা করেন। পরে এক স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে নওগাঁ-২ আসনের ভোট স্থগিত করা হয়। ভোট হবে ২৯৯ আসনে।
এদিকে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে। আজ ও আগামীকাল তারা সারা দেশে ৪৮ ঘণ্টার হরতাল কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। গতকাল রাত থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে ভোটকেন্দ্রে ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিসংযোগের খবর পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দাঁড় করানোসহ নানা কৌশল নিয়েছে। এক-তৃতীয়াংশ আসনে আওয়ামী লীগের এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরাই নির্বাচনে নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তোলার আভাস দিয়েছেন। ফলে প্রায় শতাধিক আসনে ব্যাপক উত্তেজনা বিরাজ করছে। অনেক স্থানে নির্বাচনি ক্যাম্প ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় প্রার্থীরা একে অন্যকে দোষারোপ করছেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল থেকে বারবার অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচনের তাগিদ দেয়া হলেও বিএনপিসহ ইসির নিবন্ধিত ১৬টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের বাইরে রয়েছে। নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনসহ একাধিক দাবিতে নির্বাচন থেকে দূরে রয়েছে দলগুলো।
নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রে ভোটারদের উপস্থিতি থাকলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক এবং গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা যাবে। নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে গতকাল ঢাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘নির্বাচনটা হতে দেন। গ্রহণযোগ্যতা পাবে কি না, সেটা বিদেশিরাই বলবেন। আমরা তো বলছি, ভোটার টার্ন আউট, অংশগ্রহণ সন্তোষজনক হবে। এ দেশে একটা ভালো নির্বাচন হবে। প্রধান বিরোধী দল যেখানে নেই, এটা আমরা রিগ্রেট (অনুশোচনা) করি। বিএনপি থাকলে নির্বাচন আরো প্রতিযোগিতাপূর্ণ হতো, সেটা আমরা স্বীকার করি। তারপরও এই নির্বাচন প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে।’
নির্বাচন উপলক্ষ্যে ৭২ ঘণ্টা মোটরসাইকেল চলাচলের বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ সময় কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী, প্রশাসনের সদস্য ও অনুমোদিত পর্যবেক্ষক, জরুরি সেবার যানবাহন, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সংবাদপত্র বহনকারী সব ধরনের যানবাহন (মোটরসাইকেলসহ), দূরপাল্লার যানবাহন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাদের এজেন্টদের ক্ষেত্রে এই বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে। সাংবাদিক, পর্যবেক্ষক, নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারী, জাতীয় মহাসড়ক, প্রধান আন্তঃজেলা রুট, মহাসড়ক এবং প্রধান মহাসড়কের সংযোগ সড়কের ক্ষেত্রেও বিধিনিষেধ শিথিল থাকবে।
এবারের নির্বাচনে মোট ৪২ হাজার ২৪টি কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে অপেক্ষাকৃত দুর্গম ২ হাজার ৯৬৪ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের আগের দিন আজ শনিবার ব্যালট পেপার পাঠানো হবে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এছাড়া ভোটের দিন সকালে ৩৯ হাজার ৬১ কেন্দ্রে ব্যালট পেপার যাবে। ব্যালট পেপার পরিবহন ও বিতরণে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নির্বাচন উপলক্ষ্যে অনভিপ্রেত পরিস্থিতি এড়াতে ভোটকেন্দ্র, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং ভবনের নিরাপত্তা জোরদার ও নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে ইসি। গতকাল শুক্রবার ইসির নির্বাচন ব্যবস্থাপনা শাখার উপসচিব মো. আতিয়ার রহমান নির্দেশনাটি সব রিটার্নিং কর্মকর্তাদের পাঠিয়েছেন।
নির্বাচনে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫ লাখ ১৭ হাজার ১৪৩ জন আনসার সদস্য। বাকিদের মধ্যে রয়েছে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী। ইতিমধ্যেই গত ৩ জানুয়ারি থেকে ভোটের মাঠে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত মোট আট দিন মাঠে থাকবেন তারা। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ করার লক্ষ্যে আগামী ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র বহন ও প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এ সময় পর্যন্ত লাইসেন্সধারীরাও আগ্নেয়াস্ত্র বহন করতে পারবেন না।
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আট বিভাগে ২ হাজারেরও বেশি এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োজিত রয়েছেন। বিভিন্ন অপরাধের বিচার সম্পন্ন করতে গতকাল শুক্রবার থেকে মাঠে নেমেছেন আরো ৬৫৩ জন বিচারিক হাকিম। বিচারিক হাকিমরা ভোটের আগে-পরে পাঁচ দিন দায়িত্ব পালন করবেন। সবমিলিয়ে প্রায় ৩ হাজার জুডিসিয়াল ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এর আগে সারা দেশে ৩০০ আসনের জন্য ৩০০টি নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়। তারা বিভিন্ন অপরাধে প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের রেকর্ড সংখ্যাক শোকজ, তলব ও জরিমানা করেন। এছাড়া এসব কমিটির সুপারিশে নিয়মিত আদালতে অন্তত অর্ধশতাধিক প্রার্থী ও তাদের সমর্থকের বিরুদ্ধে মামলার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। নির্বাচন দেখার জন্য যে বিদেশিরা আবেদন জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ১৮৬ জন পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিকদের অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। তাদের মধ্যে ১২৭ জন পর্যবেক্ষক আর ৫৯ জন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের কর্মী। এছাড়া নির্বাচন দেখতে দেশি ২০ হাজার ৭৭৩ জন পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। তাদের মধ্যে কেন্দ্রীয়ভাবে ৪০টি পর্যবেক্ষক সংস্থার ৫১৭ জন এবং স্থানীয়ভাবে ৮৪টি পর্যবেক্ষণ সংস্থার ২০২৫৬ জন ভোট পর্যবেক্ষণ করবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয়ে ২২ সদস্যের মনিটরিং সেল গঠন করেছে কমিশন। এই মনিটরিং সেলের নেতৃত্ব দেবেন আইডিএ প্রকল্প-২ এর প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবুল হাসনাত মোহাম্মদ সায়েম। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী, মনিটরিং সেল আজ শনিবার সকাল ৮টা থেকে ৯ জানুয়ারি সকাল ৮টা পর্যন্ত মোট ৭২ ঘণ্টা পরিচালনা করা হবে। দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বিভিন্ন উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মাঠপর্যায়ে যথাসম্ভব যাচাই-বাছাই করা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নির্বাচন কমিশনকে অবহিতকরণ এবং জরুরি প্রয়োজনে বিশেষ প্রতিবেদন পাঠাবেন।
ভোটার, প্রার্থী ও নাগরিকদের বিভিন্ন তথ্যের নিশ্চয়তা দিতে ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ নামের একটি অ্যাপ চালু করেছে ইসি। এতে ভোটার নম্বর, কেন্দ্রের নাম ও লোকেশন, ভোট পড়ার হার, প্রার্থীদের হলফনামাসহ নির্বাচনের বিভিন্ন তুলনামূলক চিত্র ঘরে বসেই জেনে নিতে পারবেন সবাই। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব মো. জাহাংগীর আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘স্মার্ট ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট বিডি’ নামের যে অ্যাপ সম্প্রতি আমরা উদ্বোধন করেছিলাম, সেখানে কেন্দ্রভিত্তিক দুই ঘণ্টা পরপর ভোট পড়ার হার জানা যাবে।
নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ে ওআইসি-কমনওয়েলথ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করেছে ইসি। ওআইসির হেড অব ইলেকশন ইউনিট সাকির মাহমুদ বান্দারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল ইসির সঙ্গে বৈঠক করেন। এতে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান ও ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে কমনওয়েলথের একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক করে ইসি। কমনওয়েলথের প্রতিনিধিদলের মধ্যে ছিলেন জামাইকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী এইচই অরিত্রি ব্রুস গোল্ডিং, ক্যামেরুনের সাবেক চেয়ারম্যান ইলেকশন কমিশনার ড. সামিউল আজিউ ফনকাম, নাইজেরিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান অব ইন্ডিপেন্ডেন্ট ন্যাশনাল ইলেকট্রোরাল কমিশন আত্তাহিরু মোহাম্মদ জেগে।
উল্লেখ্য, ইসির তথ্যানুযায়ী, দ্বাদশ নির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ। তাদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭৬ লাখ এবং নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ। আর ট্রান্সজেন্ডার ভোটার ৮৪৯ জন।

 

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

মন্তব্যসমূহ বন্ধ করা হয়, কিন্তু ট্র্যাকব্যাক এবং পিংব্যাক খোলা.

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More