নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গৌরবময় টেস্ট জয়

চ্যাম্পিয়নদের হারিয়ে ইতিহাস : একরাশ অন্ধকার ঠেলে আলোর পথে টাইগাররা
স্টাফ রিপোর্টার: আঁধার কেটে আলোর আগমন ঘটবেই। আলোকের বিচ্ছুরণ চোখ ঝলসে বিকিরণ করে সৌন্দর্য। বৈশি^ক মহামারী করোনার হানায় বিপর্যস্ত একটি বছর কাটিয়ে অবশেষে সুন্দর, ঝলমলে আলোর দেখা পেয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। টেস্ট ক্রিকেটের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে ৮ উইকেটের বিশাল ব্যবধানে পর্যুদস্ত করে মাউন্ট মঙ্গানুই জয় করেছে। দেশ থেকে ১১ হাজার ২৬৪ কিলোমিটার দূরত্বে তাসমান সাগরের পাড়ে আলোর ঝলকানিতে ইতিহাস গড়েছে বাংলাদেশ। অবিশ্বাস্য, অসম্ভব, কল্পনার চেয়ে এবং ছবির চেয়ে সুন্দর এক বিজয়গাথা এঁকেছেন মুমিনুল হকরা। অনেক আগে মরে যাওয়া আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতে সৃষ্ট ৭৫৫ ফুট উঁচু পর্বতটা জয় করেই বিশ্বের উচ্চতম মাউন্ট এভারেস্টের শৃঙ্গে উঠে গেছে টাইগাররা। কারণ এটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে প্রথম জয় বাংলাদেশের। আগে কখনও নিউজিল্যান্ডে গিয়ে কোন ফরমেটে জিততে না পারা দলটি নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে দেশের বাইরে সবচেয়ে আকর্ষণীয়, সবচেয়ে বড় জয় ছিনিয়ে এনেছে। আগের দিনই বিজয় ডঙ্কা বাজাতে শুরু করেন ডানহাতি পেসার এবাদত হোসেন চৌধুরী। তার শিকার করা ৬ উইকেটে কিউইরা দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ১৬৯ রানে গুটিয়ে যাওয়ার পর মাত্র ৪০ রানের টার্গেট ২ উইকেট খুঁইয়ে পেরিয়ে যায়।
বিজয়ের মঞ্চটা প্রস্তুত হয় মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টের চতুর্থ দিন শেষেই। ১৩০ রানের লিড পাওয়া বাংলাদেশকে জবাব দিতে নেমে এবাদতের গতির কাছে অসহায় নিউজিল্যান্ড ১৪৭ রান তুলতেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে। এর ৪টিই তুলে নেন দুর্দম্য এবাদত। অন্য কিউই ব্যাটাররা কাঁপতে থাকলেও ব্যতিক্রম ছিলেন অভিজ্ঞ রস টেইলর যার কিনা বাংলাদেশের বিপক্ষে রেকর্ডটা খুবই সমৃদ্ধ। এবাদতের ত্রাসোদ্দীপক আগুনে-বোলিংয়ের সামনে তিনি ৩৭ রানে তখনও অপরাজেয়। তাই কিউইরা ১৭ রানে এগিয়ে থাকায় জয় পাওয়ার স্বপ্নটায় রঙের তুলি দিতে পারেনি বাংলাদেশ দল। কিন্তু পঞ্চম দিন সকালে যেখানে শেষ করেছিলেন, সেখান থেকেই শুরু করলেন আবার এবাদত। তার সামনে মাথানত করলেন টেইলর। দিনের অষ্টম বলেই তাকে বোল্ড করে সাজঘরে ফেরত পাঠালেন। চিরাচরিত নিয়মে অন্যদের মতোই ৪০ রান করা টেইলরকেও স্যালুট জানিয়ে বিদায়টা জানালেন এবাদত। ক্যারিয়ারে প্রথমবার এবং ৯ বছর পর কোন বাংলাদেশী পেসার হিসেবে দেশের বাইরে ৫ উইকেট শিকার হয়ে গেছে। ততক্ষণে কিউই তাঁবুতে ভর করেছে দুঃস্বপ্ন যেখানে প্রেতাত্মার মতো বিভীষিকা হয়ে দুর্বিষহ ছিলেন এবাদত। তাই কাইল জেমিসনও ফিরে গেলেন শূন্যতে। বিপর্যস্ত কিউইদের হয়ে আর লড়তেই পারেনি কেউ। তাসকিন আহমেদের গতির কাছে নতি স্বীকার করেছেন রাচিন রবীন্দ্র (১৬) ও টিম সাউদি (০)। পরে মেহেদি হাসান মিরাজ কিউইদের দুঃসহ যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়েছেন ট্রেন্ট বোল্টকে (৮) তুলে নিয়ে। ইনজুরিতে পড়া মাহমুদুল হাসান জয়ের বদলি ফিল্ডার হিসেবে নেমে তাইজুল ইসলাম দুর্দান্ত এক ক্যাচ নেন।
মাত্র ৫৫ মিনিট ও ৬৪ বল খেলে আর ২২ রান যোগ করেই নিউজিল্যান্ডের দ্বিতীয় ইনিংস ১৬৯ রানে থেমে যায়। এবাদত ৪৬ রানে ৬ ও তাসকিন ৩৬ রানে ৩ উইকেট নেন। ২০১৩ সালের এপ্রিলে হারারে টেস্টে দুই ইনিংসে ৫ ও ৬ উইকেট নিয়েছিলেন রবিউল ইসলাম শিপলু। এবার এবাদত ৪৬ রানে ৬ উইকেট নিয়ে দেশের বাইরে দ্বিতীয় সেরা এবং পেসারদের মধ্যে সেরা বোলিংয়ের নজির গড়েছেন। সাকিব আল হাসান ২০১৮ সালে কিংসটাউনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ৩৩ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। আর পেসারদের মধ্যে বাংলাদেশের সেরা বোলিং শাহাদাত হোসেন রাজিবের। ২০০৮ সালে মিরপুরে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে নেন ২৭ রানে ৬ উইকেট। ৪০ রানের মামুলি টার্গেট পায় বাংলাদেশ। এর আগে ৩ বার টার্গেট তাড়া করে জিতেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে প্রথমবার ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে ২১৫ রান তাড়া করে ৪ উইকেটে, ২০১৪ সালে মিরপুরে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ১০১ রান তাড়ায় ৪ উইকেটে এবং ২০১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় ১৯১ রান তাড়ায় ৩ উইকেটে জয় পায় বাংলাদেশ। এবারই সবচেয়ে ছোট টার্গেট। জয়ের ইনজুরিতে ওপেনিংয়ে নামেন নাজমুল হোসেন শান্ত। তবে দ্বিতীয় ওভারেই সাউদির বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে ৩ রানে সাজঘরে ফেরেন সাদমান ইসলাম। এরপর দারুণ সতর্ক হয়ে ব্যাট চালিয়েছেন অধিনায়ক মুমিনুল হক-শান্ত। ৩১ রানের জুটি গড়েন দুজন ৭৫ বল থেকে। জয় থেকে ৬ রান দূরে থাকতে ৩ চারে ১৭ রান করে জেমিসনের বলে সাজঘরে ফেরেন শান্ত। পরে মুশফিকুর রহিম জেমিসনকে স্কয়ার কাটে চার হাঁকিয়ে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক জয় নিশ্চিত করেন। ১৩ রানে অপরাজিত থাকেন মুমিনুল। লক্ষ্য তাড়া করে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়।
আইসিসির বিশ^ টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের প্রথম চক্রে ৭ টেস্ট খেলে মাত্র একটি ড্র ছিল, এবার তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেই সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রথম চক্রের চ্যাম্পিয়ন নিউজিল্যান্ডকে তাদের মাটিতেই পরাভূত করার অবিশ্বাস্য ইতিহাস রচনা করেছে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আগের ১৫ টেস্টে শুধু ঘরের মাটিতে ৩ ড্র ব্যতীত বাকি ১২ টেস্টেই হার। এর মধ্যে নিউজিল্যান্ডে গিয়ে ৯ টেস্ট খেলে সবই পরাজয়ের তিক্ততা সঙ্গী হয়েছে। এবার লক্ষ্য, প্রত্যয়, জিদ ছিল অতীত ভুলে যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল করার। তবে কল্পনাও ছিল না বাংলাদেশ দলের কিউই ভূমিতে টেস্টে কিউই বধ করার। কারণ ২০১৭ থেকে ঘরের মাটিতে টানা ৮ সিরিজে অপরাজিত ছিল নিউজিল্যান্ড। এ সময়ে নিজেদের মাঠে ১৭ টেস্ট খেলে হারেনি তারা। আর এশিয়ার কোন দেশের ক্ষেত্রে পরিসংখ্যানটা আরও দীর্ঘ। ২০১১ সালে সর্বশেষ এশিয়ান দল হিসেবে পাকিস্তান নিউজিল্যান্ডে এসে টেস্ট জিতেছিল। তারপর এশীয় দলগুলোর সঙ্গে নিজেদের ঘরে ২১ টেস্ট খেলে হার দেখেনি তারা। এবার সেই দলটিকে টেস্ট ক্রিকেটে দুর্বলতর দল বাংলাদেশ হারিয়ে দিল। সবমিলিয়ে ১৬ টেস্ট জিতল বাংলাদেশ। দেশের বাইরে প্রথম কোন আইসিসি র‌্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে পাঁচে থাকা দলকে হারাতে পেরেছে টাইগাররা। তবে টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বড় দুই দল ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াকে যথাক্রমে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ঘরের মাটিতে হারানোর গৌরব ছিল বাংলাদেশের। ২০০৯ সালে ক্যারিবীয়দেরও হারায়। শ্রীলঙ্কা হারে ২০১৭ সালে। এবার পরাস্ত কুলীনের কাতারে যোগ হয়েছে নিউজিল্যান্ডের নাম। তাদের বিপক্ষে ২০১০ সালে প্রথম জয় পায় বাংলাদেশ ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে। এর ১১ বছর পর ঘরের মাটিতেই প্রথমবারের মতো টি২০ ম্যাচ ও সিরিজ জিতে নেয় বাংলাদেশ। এবার তাদের মাটিতে টেস্টে বিজয় কেতন ওড়ালেন মুমিনুল, এবাদত, তাসকিনরা। গত ২১ বছরে ৫ বার নিউজিল্যান্ড সফর করে ৩ ফরমেট মিলিয়ে ৩২ ম্যাচ খেলে সবই হারে বাংলাদেশ।
৬১তম টেস্টে দেশের বাইরে এটি বাংলাদেশের ষষ্ঠ জয়। ২টি ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২০০৯ সালে, ১টি শ্রীলঙ্কায় ২০১৭ সালে, ২০১৩ সাল ও গত বছর জিম্বাবুইয়েতে ১টি করে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ। গত বছর হতাশায় মোড়ানো সময়ে ৭ টেস্ট খেলে ৫ হার, ১ জয়, ১ ড্র! এ বছরের প্রথম দিন নিউজিল্যান্ডের কঠিন পরিবেশে শুরু করা টেস্টে অবিশ্বাস্য পারফর্মেন্সে অবিস্মরণীয় জয় তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৫৫ সালের পর এবারই প্রথম নতুন বছরের প্রথম দিন কোন টেস্ট খেলতে নেমে ইতিহাস রচনা করেছে বাংলাদেশ কঠিন সময় পার করে। করোনার দাপটে টানা জৈব সুরক্ষা বলয়ে বন্দিত্ব, তারপর নিউজিল্যান্ড গিয়ে ১১ দিন কোয়ারেন্টাইনের বেড়াজালে আটকে থাকা। সবসময় সব হতাশা আর বিপর্যস্ত সময়েই অবিশ্বাস্য কিছু করে টাইগাররা। এবারও করল। তাও আবার টেস্ট ক্রিকেটে টেস্টে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে। নিঃসন্দেহে খারাপ সময় কাটিয়ে আবার ছন্দে ফেরার এবং ক্রিকেটারদের আত্মবিশ্বাসী হওয়ার মোক্ষম রসদ পেয়ে গেল বাংলাদেশ। হ্যামিল্টন থেকে শুরু, তারপর ডানেডিন, ক্রাইস্টচার্চ, ওয়েলিংটনে এর আগের ৫ সফরে ৯ টেস্ট খেলে সব হেরেছে বাংলাদেশ। যেন নতুন কোন ভেন্যুতেই নিজেদের গর্জন শোনানোর অপেক্ষায় ছিল বাংলাদেশ। মাউন্ট মঙ্গানুইয়ের বে ওভালে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নেমে প্রথম সফরকারী দল হিসেবে জয় পেল বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। আর কোন দলই এই মাঠে এসে নিউজিল্যান্ডকে হারাতে পারেনি। টাইগারদের গর্জনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনারই জন্ম হলো।

Comments (0)
Add Comment