অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতায় জোর : তিস্তাসহ অমীমাংসিত বিষয়ে সমাধানে আশাবাদ

ভারতের নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা-নরেন্দ্র মোদির বৈঠক : সাতটি সমঝোতা স্মারক সই

রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ও রূপসা সেতুসহ খুলনা-দর্শনা ও পার্বতীপুর-দর্শনা রেলপথ নির্মাণ কাজের উদ্বোধন

মাথাভাঙ্গা মনিটর: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বহুল আলোচিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মঙ্গলবার দুপুরে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউজে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে দুই নেতা আশাবাদ ব্যক্ত করেন এর মাধ্যমে প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছুবে। বৈঠকে দুই নেতা বাংলাদেশ ও ভারতের পাশাপাশি পুরো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। উভয় নেতার মধ্যকার বৈঠক শেষে দুই নেতার উপস্থিতিতে দুই দেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার দুপুর ২টার দিকে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতাই সহযোগিতা আর সমঝোতার ভিত্তিতে সুখী-সমৃদ্ধ ও প্রগতিশীল দেশ গড়ার কথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, গত ৫০ বছরের গড়ে ওঠা শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ওপর ভর করে উভয় দেশ পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিস্তৃত সব বিষয় নিয়ে কাজ করছে। আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখা এবং দুই দেশ ও এ অঞ্চলের শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আমি ও প্রধানমন্ত্রী মোদি একমত হয়েছি। গত ৫০ বছরে গড়ে ওঠা শক্তিশালী অংশীদারিত্বের ওপর ভর করে উভয় দেশ পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট সব বিষয় নিয়ে কাজ করছে।

যৌথ বিবৃতিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, সন্ত্রাসবাদ ও মৌলবাদের বিরুদ্ধে সহযোগিতার বিষয়ে তারা জোর দিয়েছেন আলোচনায়। মোদির ভাষায়, ‘১৯৭১ সালের আদর্শকে জীবন্ত রেখে এই ধরনের শক্তিকে সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করা জরুরি, যারা আমাদের পারস্পরিক বিশ্বাসকে আঘাত করতে চায়।’

মোদি বলেন, বাংলাদেশ আজ ভারতের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার এবং এই অঞ্চলে আমাদের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। জনগণের সহযোগিতায় (সম্পর্কের) ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। গত বছর আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করেছি। আমরাও প্রথম ‘মৈত্রী দিবস’ উদযাপন করেছি। আগামী দিনে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছুবে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য দ্রুত বাড়ছে। আমরা তথ্য-প্রযুক্তি, মহাকাশ ও পারমাণবিক খাতে সহযোগিতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নিয়েও ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে। মোদি আরও বলেন, আমরা বন্যা প্রশমনে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে বন্যাসংক্রান্ত রিয়েল-টাইম ডেটা শেয়ার করছি এবং সন্ত্রাসবাদ নিয়েও আলোচনা করেছি। এটা অপরিহার্য, কারণ আমরা একসঙ্গে সেইসব শক্তির মোকাবেলা করি যেগুলো আমাদের প্রতিপক্ষ।

গত কয়েক বছরে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আমি বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে আলোচনা করেছি। করোনা মহামারি এবং সাম্প্রতিক বৈশ্বিক ঘটনা থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে এবং আমাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে বলে উলেস্নখ করেন মোদি। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনসংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে বলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যৌথ বিবৃতিতে বলেন, প্রধানমন্ত্রী মোদি এবং আমি ফলপ্রসূ আলোচনার আরেকটি দফা শেষ করেছি। এই আলোচনার ফলাফল উভয় দেশের জনগণের জন্য সুবিধা বয়ে আনবে। আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে বৈঠক করেছি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি মোদিজির দূরদর্শী নেতৃত্বের প্রশংসা করি। এটি আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও গতি প্রদান করে চলেছে। ভারত হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নিকটতম প্রতিবেশী। ভারত-বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক প্রতিবেশী কূটনীতির রোল মডেল হিসেবে পরিচিত।

ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বয়ে যাওয়া তিস্তা নদীর পানি ঢাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক এই নদীর পানির ন্যায্য পাওনা নিশ্চিতে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালালেও নানা কারণে এই পানি ভাগাভাগি চুক্তি বিলম্বিত হচ্ছে। দ্রুতই তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুর সমাধান হবে বলেও শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করেন।

যৌথ এই সংবাদ সম্মেলনে কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন চুক্তিকে স্বাগত জানালেও তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গ আনেননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়েছে ৫৪টি নদী এবং এগুলো শত শত বছর ধরে দুই দেশের মানুষের জীবিকার সঙ্গে সংযুক্ত থেকেছে। এসব নদী, এগুলোকে জড়িয়ে থাকা লোকগাঁথা ও লোকসংগীত আমাদের একীভূত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করছে। আমরা কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছি। এটা ভারতের দক্ষিণ আসাম ও বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলকে উপকৃত করবে।

নরেন্দ্র মোদি ও ভারতকে ধন্যবাদ জানিয়ে যৌথ বিবৃতিতে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক বিষয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমরা সমাধান করেছি। আমি মনে করি, দুই দেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, দারিদ্র্য বিমোচন করা, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা; শুধু আমাদের দুই দেশ না, দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সব এলাকা মিলেই যেন এই এলাকার মানুষ অর্থনৈতিকভাবে আরও উন্নত হয়।

তিনি বলেন, ‘প্রতিবেশীর সঙ্গে সমস্যা থাকতে পারে। সেগুলো আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। এর দৃষ্টান্ত আমরা দেখিয়েছি। যেসব সমঝোতা চুক্তি আমরা সই করেছি তা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও উন্নত করবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, এখানে আসা সত্যি খুব আনন্দের বিষয়। তিন বছর পর আবার আসতে পেরেছি। ছয় বছর রিফিউজি হিসেবে ছিলাম। সেই স্মৃতিও মনে পড়ে। তখনও সব ধরনের সহযোগিতা পেয়েছি। কাজেই ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক আমরা সেটাই চাই। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকুক। বৈঠক শেষে বহুল আকাক্সিক্ষত কুশিয়ারার নদীর পানি প্রত্যাহার, রেলের আধুনিকায়ন ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং মহাকাশ গবেষণাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা এগিয়ে নিতে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়।

গতকাল মঙ্গলবার হায়দরাবাদ হাউজে ভারতের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে নির্মিত বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট এবং রূপসা রেল সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি।

১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয়ের দেড়শ’ কোটি ডলারের বড় অংশের জোগান দিচ্ছে ভারতের এক্সিম ব্যাংক। প্রকল্পটির কাগুজে নাম ‘মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্রজেক্ট’। দেশটির এনটিপিসি লিমিটেড ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মধ্যে আধাআধি অংশীদারিত্বে এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে।

অন্যদিকে খুলনা থেকে মোংলার পথে রূপসা নদীতে রেল সেতু নির্মাণের কাজ এ বছরের জুলাইয়ে শেষ হয়েছে। সংযোগ রেললাইনসহ এই সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৫ দশমিক ১৩ কিলোমিটার হলেও মূল রেল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭১৬ মিটার। স্টিলের তৈরি এ সেতুর নির্মাণসামগ্রী ভারত থেকে সড়ক, সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ নদীপথে আমদানি করা হয়েছিল। ভারত সরকারের ঋণে নির্মিত এই সেতুর ফলে খুলনা থেকে মোংলার পথে পণ্য পরিবহণে বেশ সুবিধা মিলবে।

এছাড়া বাংলাদেশের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের জন্য নির্মাণসামগ্রী ও যন্ত্রপাতি হস্তান্তর, খুলনা-দর্শনা রেলপথ এবং পার্বতীপুর-দর্শনা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পেরও উদ্বোধন ঘোষণা করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More