আসছে রমজান বাড়ছে পণ্যের দাম : বাজার তদারকিতে মাঠে ১২ টিম

কারসাজি করলে ঈদ পর্যন্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ : হতে পারে জেল-জরিমানা

স্টাফ রিপোর্টার: পবিত্র মাহে রমজানের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম ততই বাড়ছে। ইতোমধ্যে চাল, ডাল, তেল, চিনি, আটা, ময়দা, ছোলা ও মাছ-মাংসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এত নিম্নবিত্ত ছাড়াও মধ্যবিত্তদেরও নাভিশ্বাস অবস্থা। খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের অনেকে এখন সাধ ও সাধ্যের মধ্যে মাছ-মাংস কিনতে পারছেন না। গরিবের জন্য বাজার করা এখন বড় ধরনের মানসিক কষ্ট ও হতাশার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেউ কেউ বাজারে গিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকছেন। কেউ আবার নিরুপায় ঘোরাফেরা করছেন।

এদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অন্তত নয়টি নিত্যপ্রয়োজণীয় পণ্যের দাম ঠিক করে দিতে চেয়েছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। খুব জোরেশেরে তিনি এমন ঘোষণা দিয়েছিলেন গত বছর ৯ সেপ্টেম্বর। ওইদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের বার্ষিক সম্মেলন শেষে তিনি সাংবাদিকদের এমন কথা বলেন। এমনকি তিনি এও পর্যন্ত বলেন, ‘দাম বেঁধে দিতে আমরা ট্যারিফ কমিশনকে ১৫ দিনের সময় দিয়েছি। কিন্তু ৬ মাস পার হয়ে গেলেও সেটি আর বাস্তবায়ন হয়নি।’

রমজান সামনে রেখে বাজার সামাল দিতে সরকার এখন আরও সক্রিয় হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ইতোমধ্যে বাজার মনিটরিংয়ে সরকারের অনেক সংস্থা মাঠে নেমেছে। এরমধ্যে রয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেল, শিল্প মন্ত্রণালয়, র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি), কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, বিএসটিআই, সিটি করপোরেশন ও গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক মনিটরিং টিম। পাশাপাশি এই কার্যক্রমে জেলা প্রশাসন, মৎস্য কর্মকর্তা, পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, স্যানিটারি ইন্সপেক্টর, শিল্প ও বণিক সমিতির প্রতিনিধি এবং ক্যাব সদস্যরাও প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবেন।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার রোববার বলেন, রমজানকে পুঁজি করে কেউ যাতে অতি মুনাফা করে ভোক্তাকে ঠকাতে না পারে সেজন্য সরকারের তদারকি ব্যবস্থা ঢেলে সাজানো হচ্ছে। এ সময় কোনো ধরনের অনিয়ম পেলে বাজার কমিটি বাতিলসহ অসাধু চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর কারসাজির অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঈদ পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়া হবে। এমনকি প্রয়োজনে জেলে পাঠানো হতে পারে।

এদিকে সরকারের এসব পদক্ষেপের পরও ভোক্তা পর্যায়ে শঙ্কা কাটছে না। কেননা প্রতিবছরই একটি চক্র রমজানকে টার্গেট করে পণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ভোক্তাদের পকেট কাটে। ইতোমধ্যে বাড়তি দাম নিয়ে সাধারণ মানুষের পকেট কাটা শুরু হয়ে গেছে। বেশি মুনাফাখোর ব্যবসায়ীরা বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। বিদ্যমান বাড়তি দামে রোজার প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বিক্রি হবে। এমনটি জানিয়েছে বিক্রেতাদের অনেকে।

রাজধানীর কাওরান বাজারের মুদি বিক্রেতা মো. জিহাদুল ইসলাম রোববার বলেন, রোজার দুই মাস আগ থেকেই পণ্যের দাম বাড়ানো শুরু হয়। যেমন বাজারে দুই মাস আগে ছোলার দাম প্রতি কেজি ছিল ৭৫-৮০ টাকা। কিন্তু সেই একই ছোলা এখন ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে এই পণ্যটি গত ৬ মাস আগে আনা। নতুন করে কোনো ছোলার বস্তা বাজারে আসেনি। কিন্তু দাম বেড়েছে।

জিনজিরা কাঁচাবাজারের বিক্রেতা শাক্কুর আলম বলেন, আগে রোজা আসলে ছয় থেকে সাত পণ্যের দাম অনেক বেশি বাড়ত। বর্তমানে বেশি মুনাফা করতে মোকাম পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। যার প্রভাব ক্রেতার ওপরে এসে পড়ছে। তিনি জানান, বেশি দামে কিনলে আমাদের তো কম দামে বিক্রি করার উপায় নেই।

নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মো. মাসুম বলেন, রোজার আগেই বাজারে সব ধরনের পণ্যের দামে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। এখন বাজারে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। এমনকি যেসব পণ্যের সরবরাহ ঠিকঠাক আছে সেগুলোও বেশি দাম দিয়ে কিনতে হচ্ছে। তিনি বলেন, দাম বাড়তির এই চিত্র রমজান মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত থাকবে। যা কেনার আমরা বেশি দামেই কিনব। পরে বাজার তদারকি সংস্থার লোকজন তোড়জোড় দেখিয়ে মিডিয়ার সামনে বলবেন তারা বাজার সামাল দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, বাস্তবে এ চক্রের গডফাদারদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু করতে পারবে না। মাঝখানে আমরা জনসাধারণ সবার কাছে জিম্মি। বিশেষ করে যারা চাকরিজীবী কিংবা নির্ধারিত আয়ের মধ্যে আটকে আছেন, তাদের কষ্টের শেষ নেই। সীমিত আয় দিয়ে চড়া মূল্যের বাজারে তারা কোনোদিকে কূল কিনারা করতে পারছেন না। বাজেট কাটছাঁট করতে গিয়ে হাঁফিয়ে উঠছেন। সব চাপ গিয়ে পড়ছে খাবারের ওপর।

বাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে-গত বছর একই সময়ের তুলনায় প্রতি কেজি ছোলা ১০-২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি চিনির দাম বেড়েছে ২০-৪০ টাকা, মসুর ডাল ২০ টাকা, মুড়ির দাম বেড়েছে ১০ টাকা, প্রতি লিটার বোতলজাত সরিষার তেল ৩০ টাকা, প্রতি কেজি বেসন ২০ টাকা, ইসবগুলের ভুসি ৪০০ টাকা এবং প্রতি কেজি লবণে দাম বেড়েছে ৭ টাকা। এক লিটারের রুহ আফজার বোতলের দাম বেড়েছে ৬ টাকা। প্রতি কেজি গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ১০০ টাকা, ব্রয়লার মুরগি ১০০ টাকা, খাসির মাংস ১৫০ টাকা, রসুন ১০০ টাকা, শুকনো মরিচ ২২০ টাকা, আদা ৪০ টাকা, জিরা ২৩০ টাকা এবং লবঙ্গ ৩০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। অনেকে এখন মুরগির মাংস কিনছেন কেজিতে। গরুর মাংস কিনছেন ২৫০ গ্রাম।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাজারে নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক দাম সামাল দিতে ১৫টি পণ্যকে দাম বেঁধে দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। পণ্যগুলো হলো ভোজ্যতেল, চিনি, লবণ, পেঁয়াজ, রসুন, মসুর ডাল, ছোলা, শুকনো মরিচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এলাচ, ধনে, জিরা, আদা ও তেজপাতা। ইতোমধ্যেই সয়াবিন তেল ও চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন কাজ করছে। তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, ভাবতে ভাবতে সময় শেষ হয়ে যাবে। দাম আর বেঁধে দেয়া হবে না। এগুলো আসলে কথার কথা।

জানতে চাইলে বাজার তদারকি সংস্থা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, এবার কোনোভাবে অসাধুদের সুযোগ দেয়া হবে না। অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রতিদিন সারা দেশে বাজার তদারকি শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রমজান উপলক্ষ্যে বিশেষভাবে বাজার তদারকি টিম কাজ শুরু করেছে।

জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী প্রতিবছর একই প্রক্রিয়ায় মূল্য কারসজি করে ক্রেতাকে ঠকাচ্ছেন। তবে এর কোনো স্থায়ী পদক্ষেপ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। পাশাপাশি ভোক্তাকে স্বস্তিতে রাখতে তদারকি সংস্থাগুলোর কোনো গবেষণা নেই। নেই কোনো বাজার তদারকির পরিকল্পনা। ফলে বছরের পর বছর সেই চেনা মুখ বাজারে ভোক্তার অস্বস্তি বাড়ছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More