গায়ে আগুন দিয়ে প্রতারণার শিকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতার আত্মহত্যা

আত্মহত্যার প্ররোচণার মামলায় হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক স্ত্রীসহ গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার: প্রসাধনী কোম্পানি হেনোলাক্স গ্রুপের মালিকের প্রতারণার শিকার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আনিসুর রহমান ওরফে গাজী আনিসকে (৫০) বাঁচানো গেল না। গত সোমবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তিনি নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মঙ্গলবার সকালে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক ডা. নুরুল আমিন এবং স্ত্রী ফাতেমা আমিনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তাদেরকে উত্তরা এলাকা থেকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গাজী আনিসের এমন মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। তার বন্ধু ও স্বজনরা এ মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যাকা- দাবি করে মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করেন। তারা দোষীদের আইনের আওতায় আনা এবং কঠোর শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন। গাজী আনিসের স্ত্রী এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবি করে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। শাহবাগ থানার ওসি মো. মওদুত হাওলাদার বলেন, আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে হেনোলাক্সের মালিক ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেছেন তার ভাই নজরুল ইসলাম। র‌্যাবের লিগ্যাল মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক আ ন ম ইমরান খান জানিয়েছেন, র‌্যাব-৩-এর একটি দল হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক ডা. নুরুল আমিন এবং স্ত্রী ফাতেমা আমিনকে উত্তরা এলাকার একটি বাসা থেকে গ্রেফতার করেছে। বুধবার সংবাদ সম্মেলনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানো হবে।

কুষ্টিয়ার সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও ব্যবসায়ী গাজী আনিস হেনোলাক্স কোম্পানির মালিককে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা বিনিয়োগের জন্য দিয়েছিলেন। নিজের ব্যবসার টাকা, বড় ভাইয়ের পিআরএল-এর টাকা, বন্ধু এবং স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে এসব টাকা দিয়েছিলেন তিনি। প্রতিমাসে ৫ লাখ টাকা লাভ দেয়ার কথা ছিল। এছাড়া দুই বছর পর সব টাকা পরিশোধের কথা ছিল তার সঙ্গে। তবে পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠায় সরলবিশ্বাসের ভিত্তিতে টাকা দিয়েছিলেন তিনি। এসব লেনদেনের ছিল না কোনো ব্যাংক ডকুমেন্ট। কয়েক মাস দিয়ে পরে লভ্যাংশ দেয়া বন্ধ করে দেন হেনোলাক্সের কর্ণধাররা। এরপর এই পাওনা টাকা আদায়ে নানা চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সব চেষ্টা চালিয়ে যখন ব্যর্থ, এই অবস্থায় অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে বেঁচে নেন আত্মহননের পথ। সোমবার বিকেল পৌনে ৫টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের খোলা চত্বরে হঠাৎ করেই গাজী আনিস নিজ গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। অনেকেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করেছেন। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, গাজী আনিস হাত-পা ছড়িয়ে নিথর হয়ে পড়ে আছেন। তার সারা শরীরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। এ সময় আশপাশের লোকজন ছুটে গিয়ে তার গায়ে পানি ঢেলে আগুন নেভান। যদিও ততক্ষণে তার শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে যায়। একটা ছবিতে দেখা যায়, তার গায়ে পানি ঢালা হচ্ছে, পরিধেয় কাপড় পুড়ে গিয়ে তিনি বিবস্ত্রপ্রায় হয়ে আছেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে উদ্ধার করে দ্রুত শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করে।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, গাজী আনিসের শরীরের ৯০ শতাংশের বেশি দ্বগ্ধ ছিল। তার শ্বাসনালিসহ পুরো শরীরই বলতে গেলে পুড়ে গিয়েছিল। বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তির পর তাকে বাঁচাতে আমাদের চিকিৎসকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন। অবস্থা সংকটাপন্ন হওয়ায় সোমবার রাতেই তাকে আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়। তাকে লাইফ সাপোর্টে দেওয়া হয়। আমরা আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছি। কিন্তু এত বড় গুরুতর দ্বগ্ধের কারণে তাকে বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে। মঙ্গলবার সকাল সোয়া ৬টার দিকে গাজী আনিস মারা যান।

এদিকে গাজী আনিসের এ মর্মান্তিক মৃত্যুর খবর পেয়ে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ছুটে যান তার পরিবার, স্বজন ও বন্ধুবান্ধবরা। তার এমন মৃত্যু মানতে পারেননি তারা। স্বজনের আহাজারিতে বার্ন ইনস্টিটিউট এবং ঢামেক মর্গ এলাকায় বেদনাবিধূর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। খবর পেয়ে গাজী আনিসের শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে মঙ্গলবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে আসেন আওয়ামী লীগের যুগ্মসাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, যে কোম্পানি বা ব্যক্তি গাজী আনিসের টাকা নিয়ে ঘুরোনো বা আত্মসাতের কারণে আজ তার (গাজী আনিস) জীবন বিপন্ন হয়েছে। আমরা শুধু টাকা উদ্ধারই করবো না, দায়ীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর ব্যবস্থা করবো।

এদিকে এক প্রশ্নের জবাবে মঙ্গলবার রাতে মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, ‘তার এ সমস্যার বিষয়টি তিনি কখনও আমার সঙ্গে শেয়ার করেননি। বিষয়টি জানলে আমরা অবশ্যই একটা ব্যবস্থা নিতাম।’

ঢামেক মর্গে গাজী আনিসের বন্ধু তৌহিদুল ইসলাম বলেন, হেনোলাক্স গ্রুপের মালিক এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে ২০১৬ সালে গাজী আনিসের পরিচয় হয়। এরপর তাদের সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একসঙ্গে তারা ভারতে একাধিক ট্যুরেও গিয়েছিলেন। সেই সম্পর্কের খাতিরে ব্যবসা করার জন্য গাজী আনিসের কাছ থেকে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নিয়েছিলেন ফাতেমা আমিন। প্রতিমাসে পাঁচ লাখ টাকা করে লভ্যাংশ দেওয়ার কথা ছিল। দুই বছর পর মূল টাকা পরিশোধের কথা ছিল। দুই-তিন মাস ব্যবসার লভ্যাংশ দিয়েছিলেন। এরপর তারা সেটা বন্ধ করে দেন। তিনি জানান, বড় ভাইয়ের পিআরএল (অবসরোত্তর) টাকা, বন্ধু এবং স্বজনদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে এসব টাকা নিয়েছিলেন গাজী আনিস। লভ্যাংশ দেওয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে টাকা এনেছিলেন। তারাও টাকা ফেরতের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। সেই টাকা উদ্ধারের জন্য তিনি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। নানাজনের কাছে ধরনা দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা উদ্ধার করতে না পেরে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। যাদের কারণে তিনি আত্মহননের পথ বেঁচে নিলেন আমরা তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি। এ ঘটনায় মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন গাজী আনিসের বড় ভাই নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, মৃত্যুর মাসখানেক আগে গাজী আনিস তার ফেসবুকে ঘটনার আদ্যোপান্ত লিখে গিয়েছেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, রোববার দুপুর ১১টা ৫৫ মিনিটে গাজী আনিস তার ব্যবহৃত ফোন থেকে কল করে আমাকে (বাদী) জানান, পাওনা টাকা ফেরত দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ডা. নুরুল আমিন ও ফাতেমা আমিন রোববার বিকেলে তাকে চেক দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু বিকেলে যোগাযোগ করলেও তারা আমার ভাইকে চেক প্রদান করেননি। সেই ক্ষোভে আমার ভাই বিকেল পৌনে ৫টায় প্রেসক্লাব চত্বরে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে দগ্ধ হন। পরে তিনি মঙ্গলবার সকালে মারা যান।

প্রসঙ্গত, গাজী আনিসের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পান্টি গ্রামে। তিনি ১৯৯৩ সালে কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হয়েছিলেন। পরবর্তীতে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলেন। তার প্রকাশিত কয়েকটি বইও রয়েছে। গাজী আনিস নিজের ফেসবুক আইডিতে গত ২৫ মে ৪২২ শব্দের একটি পোস্ট করেন। ওই পোস্টে তিনি হেনোলাক্সের কাছে প্রতারণার শিকার হওয়ার আদ্যোপান্ত উল্লেখ করেন। সেখানে গাজী আনিস লেখেন, ‘আমি মো. আনিসুর রহমান (গাজী আনিস) একজন কবিতাপ্রেমী মানুষ। নিজে ভালো কবিতা লিখতে না পারলেও কবিতাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। আমি একজন ব্যবসায়ী এবং জীবনে প্রচুর রোজগার করেছি। আমার রোজগারের সবচেয়ে বড় অংশ স্থানীয় স্কুল মাদরাসা মসজিদ এবং অসহায় দুস্থ মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি। সেইসঙ্গে নিজেও সুখী স্বাচ্ছন্দ্যময় এবং সৎ জীবনযাপন করেছি। আমি তিন কন্যা সন্তানের জনক। আমার বড় মেয়ে মেধা রহমান আঁচল এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী, মেজ মেয়ে প্রতিভা রহমান অহনা এসএসসি পরীক্ষার্থী এবং ছোট মেয়ে জয়িতা রহমান অবনী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত।’

২০১৬ সালে হেনোলাক্স গ্রুপের কর্ণধার মো. নুরুল আমিন এবং তার স্ত্রী ফাতেমা আমিনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। ধীরে ধীরে তাদের সঙ্গে আমার সখ্য এবং আন্তরিকতা গড়ে ওঠে। আমি কুষ্টিয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেছি এবং কুষ্টিয়া শহরেই বসবাস করি।

তবে প্রতিমাসেই নিজের প্রয়োজনে ঢাকা এলে তাদের সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ হতো। উপহার বিনিময় ও ভালো রেস্তোরাঁয় আমরা একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করতাম। বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেতাম। যেহেতু আমি স্বাচ্ছন্দ্য দিনযাপনে অভ্যস্ত এবং অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী। নিজস্ব গাড়িতেই সব সময় যাতায়াত করি। আমি মো. নুরুল আমিন এবং ফাতেমা আমিনের সঙ্গে নিজের খরচায় দেশের বাইরেও একাধিকবার বেড়াতে গিয়েছি। ২০১৮ সালে কোলকাতা হোটেল বালাজীতে একই সঙ্গে অবস্থান করি আমরা। সেসময় উনারা আমাকে হেনোলাক্স গ্রুপে বিনিয়োগের এবং যথেষ্ট লাভবান হওয়ার সুযোগ আছে বলে জানান। আমি প্রথমে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেও পরবর্তীতে রাজি হই এবং প্রাথমিকভাবে এক কোটি টাকা বিনিয়োগ করি। পরবর্তীতে তাদের পীড়াপীড়িতে আরও ছাব্বিশ লাখ টাকা বিনিয়োগ করি (অধিকাংশ টাকা ঋণ হিসাবে আত্মীয়স্বজন বন্ধু-বান্ধবের কাছ থেকে নেওয়া)। বিনিয়োগ করার সময় পরস্পরের প্রতি সম্মান এবং বিশ্বাসের কারণে এবং তাদের অনুরোধে চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তি করা হয়নি। তবে প্রাথমিক চুক্তি করা হয়েছে। বিনিয়োগ পরবর্তী চূড়ান্ত রেজিস্ট্রি চুক্তিপত্র সম্পাদন করার জন্য বারবার অনুরোধ করি। কিন্তু উনারা গড়িমসি করতে থাকেন। এক পর্যায়ে উনারা প্রতিমাসে যে লভ্যাংশ প্রদান করতেন সেটাও বন্ধ করে দেন। কয়েকবার উনাদের লোকজন দ্বারা আমাকে হেনস্তা ও ব্ল্যাকমেইল করেন এবং করার চেষ্টা করেন। বর্তমানে লভ্যাংশসহ আমার ন্যায্য পাওনা তিন কোটি টাকার অধিক।

এ বিষয়ে কুষ্টিয়া আমলি আদালতে আমি উনাদের আসামি করে দুটি মামলা দায়ের করেছি, যা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া গত ২৯ মে জাতীয় প্রেসক্লাব ঢাকায় সাংবাদিক সম্মেলন করি। আমি আমার যাবতীয় ডকুমেন্টস সম্মানিত সাংবাদিকদের কাছে উপস্থাপন করি।’

এদিকে মঙ্গলবার দুপুরে ৩/১ পুরানা পল্টনে অবস্থিত হেনোলাক্স টাওয়ারের গিয়ে কোম্পানিটি বন্ধ পাওয়া যায়। বারবার নুরুল আমিন ও তার স্ত্রীর মোবাইলে ফোন করা হলেও নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। ঘটনার পর থেকে তারা দুজন গা-ঢাকা দেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More