বিএনপিতে অজ্ঞাত আসামি : নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন আতঙ্ক

এজাহারভুক্ত আসামি না হলেও আত্মগোপনে অনেকেই গ্রেফতারের আগে জামিনের সুযোগ নেই

স্টাফ রিপোর্টার: ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গত কয়েক মাসে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বোমাবাজি, নাশকতার পরিকল্পনা ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় শ’ দেড়েক মামলা হয়েছে। এসব মামলার এজাহারে বিপুলসংখ্যক আসামির নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি ১৫ সহস্রাধিক ‘অজ্ঞাত আসামি’ রয়েছে। যা বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন আতঙ্ক ছড়িয়েছে। মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের ভাষ্য, মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি গ্রেপ্তার এড়াতে আগে থেকে সতর্ক থাকতে পারেন। আদালত থেকে জামিন নেয়ারও সুযোগ থাকে। তবে অজ্ঞাত আসামিদের মামলার চার্জশিট দেয়ার এবং গ্রেফতারের আগে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই মামলার আসামি না হয়েও সংশ্লিষ্ট থানা এলাকার সক্রিয় নেতাকর্মীদের আত্মগোপনে থাকতে হয়। গ্রেপ্তার এড়াতে দলীয় আন্দোলন কর্মসূচিতে যোগ দেয়ার সুযোগও কমে যায়। তাদের আরও অভিযোগ, অজ্ঞাত আসামি ধরপাকড়ের অজুহাতে থানা পুলিশের ‘চাঁদাবাজির’ সুযোগ তৈরি হয়। আর্থিকভাবে সচ্ছল যে কোনো নেতাকর্মীকে আটক করে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তারের ভয় দেখিয়ে মোটা অঙ্কের ‘ঘুষ’ দাবি করেন পুলিশ সদস্যদের কেউ কেউ। অস্বীকার করলে অজ্ঞাত আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, এর সঙ্গে শুধু মামলার বাদী নন, পুলিশ এবং একশ্রেণির আইনজীবীও জড়িত থাকেন। থানায় দায়ের করা মামলায় পুলিশের হাত থাকে। আর আদালতের মামলায় হাত থাকে কিছু আইনজীবীর। আর যেসব মামলা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য দায়ের করা হয় তার পেছনে থাকেন স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতারা। বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের দাবি, ১০ ডিসেম্বরের আগ পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক গায়েবি মামলা দিয়ে সক্রিয় কর্মীদের এতদিন ধাওয়ার ওপর রাখা হয়েছে। শনিবার ঢাকায় গণসমাবেশ শেষ হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপর হয়ে উঠেছে। পুলিশ মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের বাসাবাড়িতে হানা দিচ্ছে। তবে গ্রেপ্তার এড়াতে তাদের বেশিরভাগই অন্যত্র আত্মগোপন করে আছে। কিন্তু যাদের নাম মামলার এজাহারে নেই তারা বেশিরভাগই বাসায় অবস্থান করছেন। এ সুযোগে ঢাকার গণসমাবেশসহ বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচিতে যেসব নেতাকর্মী বেশি তৎপর ছিল পুলিশ তাদের আটক করে ‘অজ্ঞাত আসামি’র তালিকায় ঢুকিয়ে দিচ্ছে। এদিকে ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে ধরপাকড় অভিযান জোরদার করার কথা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। তাদের ভাষ্য, ১০ ডিসেম্বর ঘিরে নানা ধরনের উদ্বেগ-আতঙ্ক থাকায় ঢাকাসহ সারা দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারেই পুলিশ এতদিন বেশি তৎপর ছিল। এখন সে শঙ্কা কেটে যাওয়ায় আসামিদের ধরপাকড়ের দিকে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। তবে বিএনপির সক্রিয় নেতাদের বেছে বেছে ‘অজ্ঞাত আসামির’ তালিকায় ঢোকানোর অভিযোগ সঠিক নয় বলে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। তাদের ভাষ্য, সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে অজ্ঞাত আসামিদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। মামলার তদন্ত, গ্রেপ্তারকৃত এজাহারভুক্ত আসামিদের স্বীকারোক্তি এবং ক্ষেত্র বিশেষ নাশকতা-হামলার ঘটনার ভিডিও চিত্র পর্যালোচনা করে মামলার এজাহারের বাইরে যাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকেই শুধু পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। নিরীহ ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে গ্রেপ্তারের অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন পুলিশের ঊর্ধ্বতনরা। এদিকে গত ৭ ডিসেম্বর রাজধানীর নয়া পল্টনে বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে একজন নিহত ও পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হওয়ার ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অজ্ঞাত আসামিদের গ্রেপ্তারে পুলিশের তৎপরতা বাড়ানোর কথা স্বীকার করে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, নয়া পল্টনে বিএনপির কার্যালয়ের সামনে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় কয়েকটি মামলা হয়েছে। ওসব মামলার অজ্ঞাতনামা আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য বিভিন্ন ফুটেজ ও তথ্য পর্যালোচনা করে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করেছে। তিনি আরও বলেন, নয়া পল্টনের বিএনপি কার্যালয় ও আশপাশের এলাকার বিভিন্ন গলির সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়েছে। বিশেষ করে যেসব গলিতে বিএনপির নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে পুলিশের ওপরে হামলা করেছিল। থানা পুলিশের পাশাপাশি ডিবির একাধিক টিমও সিসিটিভি ফুটেজ দেখে অপরাধীদের শনাক্তে কাজ করছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বলেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনলাইন মনিটরিং সেল থেকে তাদের নজরদারি শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে নয়া পল্টনসহ আশপাশের এলাকা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করা হচ্ছে। পর্যালোচনা করা হচ্ছে কে বা কারা পুলিশের ওপর হামলায় জড়িত ছিল। এছাড়া বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসা নেতাকর্মীদের ওপর নজরদারিতে রাখা হয়েছে। ?ফুটেজে আসা নেতাকর্মীদের কার্যালয়ের সামনে থেকে গ্রেপ্তার না করে আশপাশের এলাকা থেকে তাদের আটক করার পরিকল্পনা রয়েছে গোয়েন্দাদের। রাজধানীর নয়া পল্টনে গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপি-পুলিশ সংঘর্ষে একজন নিহত ও পুলিশসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। ‘পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা’ দেওয়ার অভিযোগে রাজধানীর পল্টন ও রমনা থানায় পরদিন ৮ ডিসেম্বর তিনটি মামলা দায়ের করে পুলিশ। এসব মামলায় ৪৭৩ জনের নাম উলেস্নখ করে আরও দেড় দুই হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। গত ১২ ডিসেম্বর লক্ষ্ণীপুরের রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। রামগতি পৌর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মাফু বাদি হয়ে ৩৬ জনের নাম উলেস্নখ ও অজ্ঞাত ১০০-১৫০ জনের বিরুদ্ধে মামলাটি দায়ের করেন। রামগতি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। গত ৩ সেপ্টেম্বর কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ায় বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে দলটির নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনায় দেড় হাজার জনকে আসামি করে মামলা করে পুলিশ। এর মধ্যে মাত্র ১৩৮ জনের নাম উলেস্নখ করা হয়েছে। বাকিরা অজ্ঞাত আসামি। পাকুন্দিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. শাহ কামাল পুলিশি কাজে বাধা, পুলিশ সদস্যের মারধরের অভিযোগ এনে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এ মামলাটি রুজু করেন। গত ১৫ অক্টোবর ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও পুলিশ আহত হওয়ার ঘটনায় মামলা দায়ের করে কোতোয়ালি পুলিশ। এতে ২৩ জনের নাম উলেস্নখ করে আরও অজ্ঞাত ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, আসামিরা সংঘবদ্ধ হয়ে রাস্তায় জনগণের চলাচলে বাধা, পুলিশের কাজে বাধা ও পুলিশের ওপর হামলা চালিয়েছে। ২০ নভেম্বর রাজশাহীর দুর্গাপুরে ককটেল বিস্ফোরণ ও নাশকতার অভিযোগে বিএনপির প্রায় দুইশ’ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। এ সময় অবিস্ফোরিত চার থেকে পাঁচটি ককটেল এবং বিপুল পরিমাণ লাঠিসোঁটা ও হামলায় ব্যবহৃত ইটের ভাঙারি উদ্ধার দেখানো হয়েছে। দায়েরকৃত মামলায় মাত্র ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও অজ্ঞাত আসামি ১৮০ জন। একই দিন ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় পাবনায় বিএনপির স্থানীয় ৭ নেতার নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাত আরও ১৫০ জন নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এদিন বিকাল ৫টার দিকে ট্রাফিক মোড়ের ঘোড়াস্ট্যান্ডে ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে এই মামলা করা হয়। তবে স্থানীয় বিএনপি নেতাদের অভিযোগ, ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর সমাবেশে বাধা দেয়ার উদ্দেশ্যেই তাদের হয়রানির জন্য গায়েবি মামলা দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গ্রেপ্তারের আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছিলেন, নির্বাচন ঘনিয়ে এলেই বিরোধী শক্তিকে দমাতে সরকার এজাহারভুক্ত আসামির পাশাপাশি শত শত অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে গায়েবি মামলার কৌশল অবলম্বন করে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা দিয়ে ব্যস্ত রেখে ক্ষমতাসীনরা নিজেদের কাজ শেষ করে নেবে। মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান বলেন, ‘নির্বাচনের আগে মিথ্যা বা গায়েবি মামলার রাজনৈতিক ব্যবহার সব সরকারের আমলে দেখা যায়। এর উদ্দেশ্য রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ঘায়েল করা। তাদের ভয়ের মধ্যে রাখা অথবা কারাগারে আটক রাখা। এসব মামলার মধ্য দিয়ে রাজনীতি করার যে অধিকার তা বাধাগ্রস্ত করা হয়। ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়। বাকস্বাধীনতাকে সংকুচিত করা হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মিথ্যা মামলা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। স্থানীয় বিরোধ, দুই পরিবারের মধ্যে বিরোধ, জমিজমা নিয়ে দ্বন্দ্ব- এসব কারণে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে মিথ্যা মামলা অতীত থেকে চলে আসছে। তবে রাজনৈতিক গায়েবি মামলা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এটা সরাসরি রাজনৈতিক প্রভাবে হচ্ছে যা আমাদের পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করছে।’ অজ্ঞাত পরিচয় মামলা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এটা সাধারণ মানুষকে হয়রানি এবং পুলিশের উৎকোচ আদায়ের একটি বড় হাতিয়ার। নিরীহ ব্যক্তিকে ওইসব মামলায় সন্দেহভাজন হিসেবে আটক বা আটকের ভয় দেখিয়ে একশ্রেণির পুলিশ বাণিজ্য করে। আর এর রাজনৈতিক ব্যবহারও আছে। কোনো রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে আটকের পর কোনো মামলা না থাকলে অজ্ঞাত পরিচয়ে মামলায় আটক দেখানো হয়।’

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More