বিএনপির গণসমাবেশ ঘিরে সীমাহীন দুর্ভোগে সাধারণ মানুষ

দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা পর খুলনার পথে ট্রেন : দুদিন পর বাস চলাচল স্বাভাবিক

স্টাফ রিপোর্টার: দীর্ঘ ১২ ঘণ্টা পর ঢাকা থেকে খুলনাগামী আন্তনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনের মাধ্যমে চুয়াডাঙ্গা থেকে খুলনার পথে আবার রেল চলাচল শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে ট্রেনটি খুলনার উদ্দেশে চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন ত্যাগ করে। অন্যদিকে সময়-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে খুলনা-রাজশাহী রেলপথে চলা আন্তঃনগর সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনের ফিরতি যাত্রা (খুলনা থেকে রাজশাহী) বাতিল করা হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে খুলনাগামী সব ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। তার আগে মহাসড়কে নছিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইকসহ সব অবৈধ যান চলাচল বন্ধের দাবিতে হঠাৎ শুক্রবার ও শনিবার দুদিন ধর্মঘটের ডাক দেয় জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতি। ধর্মঘটে একাত্মতা প্রকাশ করে খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। এরপর লঞ্চ চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে শুক্রবার থেকে কার্যত দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে খুলনা। শনিবার খুলনায় বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ ছিলো। দলটির অভিযোগ, তাদের গণসমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ঠেকাতে ‘ষড়যন্ত্র’ করে এ ধর্মঘট ও ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে খুলনাগামী সব পরিবহন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন সাধারণ যাত্রীরা। কোনো ধরনের ঘোষণা ছাড়াই ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যাত্রীদের ব্যাপক দুর্ভোগ পোয়াতে হয়। দুদিনপর বিএনপির সমাবেশ শেষে বিকেলে থেকে খুলনার সাথে পরিহবন চলাচল স্বাভাবিক হয়। খুলনা থেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন রুটে বাস চলাচল শুরু হয়েছে। গণপরিবহণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুপুরে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হয়। অন্যদিকে বিকেল থেকে ট্রলার ও লঞ্চ চলাচলও শুরু হয়েছে। এতে শ্রমিকদের অঘোষিত দুই দিনের ধর্মঘট শেষ হলো।

খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন বিপ্লব বলেন, এ ধর্মঘটের বিষয়টি ছিল মালিকদের। সেই ধর্মঘটে শ্রমিকরা সংহতি প্রকাশ করেন। মালিকরা আবার বাস চালানোর অনুমতি দেওয়ায় সড়কপথে গণপরিবহণ চালু হয়েছে। বিকেলের পর থেকে চলাচল স্বাভাবিক হয়।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুর রহমান তার একমাত্র মেয়েকে জরুরি প্রয়োজনে যশোরে পাঠাতে সকালে চুয়াডাঙ্গা স্টেশনে আসেন। সকাল ৯টা ১৯ মিনিটে সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও সেটি স্টেশনেই আসেনি। তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পরও ট্রেনর বিষয়ে রেলের কর্মকর্তারা কিছু বলতে না পারায় দুপুর সোয়া ১২টার দিকে হতাশ হয়ে তিনি বাড়িতে ফিরে যান।

চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ে স্টেশন মাস্টারের কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চিলাহাটি থেকে ছেড়ে আসা সীমান্ত এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৩ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট দেরিতে শনিবার ভোর ৪টা ১৮ মিনিটে খুলনার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এরপর টানা প্রায় ১২ ঘণ্টা চুয়াডাঙ্গা থেকে খুলনার পথে কোনো ট্রেন ছেড়ে যায়নি। অথচ সিডিউল অনুযায়ী এ সময়ে তিনটি আন্তঃনগর ও একটি মেইল ট্রেন খুলনার পথে ছেড়ে যাওয়ার কথা ছিলো।

রেলস্টেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনটি বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে খুলনার উদ্দেশে চুয়াডাঙ্গা স্টেশন ত্যাগ করে। ট্রেনটি বেলা ২টা ৪৫ মিনিটে ছেড়ে যাওয়ার কথা থাকলেও দেরি হয় এক ঘণ্টা ২০ মিনিট। এরপর সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত ছয়টি ট্রেন খুলনার পথে ছেড়ে গেছে। সবচেয়ে বেশি দেরিতে যায় রাজশাহী থেকে আসা আন্তঃনগর সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেন। ট্রেনটি প্রায় ৮ ঘণ্টা দেরিতে বিকেল ৫টা ১৩ মিনিটে ছেড়ে যায়। অন্য ট্রেনগুলোর মধ্যে মহানন্দা এক্সপ্রেস ৫ ঘণ্টা দেরিতে বিকেল ৫টা ১৫ মিনিটে, রূপসা এক্সপ্রেস ৩ ঘণ্টা দেরিতে ৬টা ৪৮ মিনিটে ও কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ৩৫ মিনিট দেরিতে ৫টা ৩৮ মিনিটে ছেড়ে যায়।

চুয়াডাঙ্গা রেলওয়ের স্টেশন মাস্টার মিজানুর রহমান সন্ধ্যায় বলেন, সময়-সংক্রান্ত জটিলতার কারণে খুলনা থেকে রাজশাহীগামী (ঊর্ধ্বমুখী) আন্তঃনগর সাগরদাঁড়ি এক্সপ্রেস ট্রেনটির যাত্রা বাতিল করা হয়েছে। ওই ট্রেনের খুলনা থেকে বিকেলে ছেড়ে আসার কথা ছিলো। রাত ৯টা ১৫ মিনিটে চিলাহাটিগামী সীমান্ত এক্সপ্রেস ও রাত ১০টা ১৫ মিনিটে ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি খুলনা থেকে ছেড়ে আসে এবং চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন থেকে পর্যায়ক্রমে রাত ১১টা ৫৬ ও ১২টা ৫৬ মিনিটে গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।

বিএনপির নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাদের গণসমাবেশে মানুষের স্রোত ঠেকাতে এ ব্যবস্থা করেছে সরকার। আর পরিবহন সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, তাদের কিছু দাবিদাওয়া ছিল, যেগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাস্তবায়নের জন্য বলা হচ্ছে। সেগুলো না মেনে নেয়ায় তারা যানবাহন বন্ধ করে ‘আন্দোলন’ করছেন। তবে তাদের এই আন্দোলন কাকতালীয়ভাবে বিএনপির সমাবেশের আগের দিন থেকে সমাবেশের পরের দিন পর্যন্ত পড়ে গেছে। গত বুধবার সকালে খুলনা জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতির বৈঠকের পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অমান্য করে সড়ক ও মহাসড়কে অবৈধভাবে নছিমন, করিমন, মাহিন্দ্রা, ইজিবাইক ও বিআরটিসির গাড়ি চলাচল করছে। ২০ অক্টোবরের মধ্যে প্রশাসন যদি সড়কে ওই অবৈধ যান চলাচল ও কাউন্টার বন্ধ না করে, তাহলে পরবর্তী দুইদিন ২১ ও ২২ অক্টোবর (শুক্র ও শনিবার) মালিক সমিতির সব রুটের গাড়ি বন্ধ থাকবে। ‘ধর্মঘটের’ সঙ্গে একাত্মতা জানায় খুলনা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন। প্রশাসন ‘দাবি না মানায়’ শুক্র ও শনিবার সব রুটের গাড়ি বন্ধ ছিলো। খুলনা জেলা বাস, মিনিবাস, কোচ, মাইক্রোবাস মালিক সমিতির সভাপতি হলেন মো. মিজানুর রহমান। তিনি খুলনা-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের খুলনা মহানগর শাখার সাবেক সাধারণ সম্পাদক। মিজানুর রহমান বলেছিলেন, ধর্মঘটের সঙ্গে বিএনপির সমাবেশের কোনো সম্পর্ক নেই। বাংলাদেশ লঞ্চ শ্রমিক ইউনিয়ন খুলনা জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেছিলেন, লঞ্চশ্রমিকদের বেতন বাড়ানো, ভৈরব থেকে নওয়াপাড়া পর্যন্ত নদের খনন, ভারতগামী জাহাজের ল্যান্ডিং পাস দেওয়ার দাবিসহ ১০ দফা দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন যাত্রীবাহী লঞ্চের শ্রমিকেরা। বাস ও লঞ্চের সঙ্গে খুলনা শহরের পাশে রূপসা ঘাটেও নৌকা চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ওই ঘাটের মাঝি সংঘের সভাপতি মো. রেজা ব্যাপারী বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে জনপ্রতি ভাড়া বাড়ানোর দাবি করা হয়েছে। ওই দাবি মেনে না নেয়ায় তারা ধর্মঘটের কর্মসূচি দিয়েছেন। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়লেও তাদের ভাড়া বাড়ানো হয়নি। ভাড়া বাড়ানোর দাবিতে এর আগে সিটি করপোরেশনের মেয়র, খুলনা জেলা প্রশাসক, রূপসা উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত আবেদন করা হয়েছিলো। কিন্তু তাতে কেউ সাড়া দেননি। খুলনা ছাড়া বাকি ৯টি জেলার বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, খুলনা মালিক সমিতির ডাকা ধর্মঘটের সমর্থনে তারা ওই রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখেন। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ছেড়ে আসা খুলনাগামী বাস যশোর টার্মিনালে এসে থেমে যায়। সেখানেই নামিয়ে দেয়া হচ্ছে যাত্রীদের। যশোরের পরিবহনশ্রমিকেরা বলেন, খুলনায় বিএনপির গণসমাবেশ থাকায় যশোর থেকে খুলনাগামী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। কী কারণে বাস চালানো বন্ধ রয়েছে, তা তারা বলতে পারেন না। আন্তঃজেলা বাস সিন্ডিকেট যশোরের সাধারণ সম্পাদক পবিত্র কাপুড়িয়া বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আমরা নিজেরাই বিএনপিকে বাস ভাড়া দিচ্ছি না। একই কারণে খুলনা রুটে বাস চলাচলও বন্ধ ছিলো।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More