চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে পুলিশের গুলিতে নিহত রনির গ্রামের বাড়ি চুয়াডাঙ্গার জীবননগরে

স্টাফ রিপোর্টার: ভূমিহীন দরিদ্র পরিবারের ছেলে রাকিব হাসান রনির বয়স মাত্র ২২ বছর।  তার বাড়ি চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মিনহাজপুর গ্রামে। মা, বাবা ও ভাই-বোনকে নিয়ে থাকতেন টিনের ছাউনি দেয়া একটি ছোট ঘরে।  তিন ভাই-বোনদের মধ্যে সে ছিল সবার ছোট।  বাবা মোহাম্মদ ওলিউল্লাহ একজন বর্গাচাষী। কোন রকমে চলে তাদের সংসার। মেজো ভাই ইসমাইল বাবু গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। গত দুই বছর আগে মেজো ভাই ইসমাইল বাবুকে কাজের তাগিদে সৌদি আরব পাঠান বাবা।  কিন্তু সেখানে ভাল কাজ না পাওয়ায় খুব কষ্টে দিনযাপন করতে হচ্ছে বাবুকে।

বড় বোন লাইলী খাতুন এইচএসসি পাশের পর তার বিয়ে দেয়া হয়। যৌতুক দিতে না পারায় তাকে তালাক দেয় তার স্বামী।  এখন তিনি বাড়িতেই থাকেন।  এমন অবস্থায় মা গোলনাহার বেগমেরও চিন্তার শেষ ছিলনা।  টগবগে যুবক রনির মেধা থাকলেও খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি। এলাকার কাশিপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন তিনি।  তাকে পিছুহটতে বাধ্য করেছে দারিদ্রতা।  তিনি খুব অল্প বয়সে নেন অভাবের সংসারের দায়িত্ব।

গত ৯ মাস আগে রনি কাজ করতে যান চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা এলাকায় কয়লাবিদ্যুত কেন্দ্রে। ওই গ্রামের অনেকেই ভাগ্য বদলের জন্য কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রে চাকরি করেন। তাদের দেখাদেখি দরিদ্র বাবার কষ্ট লাঘব করতেই ওই কোম্পানিতে চাকরি নেন রনি। চাকুরি নেয়ার পর খুব ভালোভাবেই চলছিল তাদের সংসার।  এরই মধ্যে গত ১৭ এপ্রিল শনিবার ঘটে দুর্ঘটনা।  ওই দিন দুপুরে এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ওই কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা।  স্থানীয় লোকজন ও পুলিশের সাথে তাদের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়।  এসময় পুলিশ গুলি ছুঁড়লে গুলিবৃদ্ধ হয়ে পাঁচজন নিহত হয়।  মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রনি।

গেল রোববার রাত ২টার দিকে তার মরদেহ নেয়া হয় নিজ গ্রাম মিনহাজপুরে।  নিহতের মরদেহ দেখতে ছুটে আসেন গ্রামের শত শত নারী পুরুষ।  এসময় স্বজনদের কান্না ও আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠে সেখানকার বাতাস।  রনির আকষ্মিক মৃত্যুতে তার পরিবারে চলছে শোকের মাতম।  আদরের ছোট ছেলের মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন মা-বাবা।  ভাইয়ের মৃত্যুতে একমাত্র বোন লাইলী খাতুনও কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।  গতকাল সোমবার সকাল ৮টার দিকে জানাজা শেষে গ্রামের কবরস্থানে রনির মরদেহ দাফন করা হয়।

নিহত রনির মা গোলনাহার বেগম জানান, ‘আমার এক ছেলি বিদেশ থাকে।  রনি আমাকে দেকাশুনা করতু। এখন আমাকে দেকবি কে?।  রনি এক সপ্তাহ আগে রাতি আমার সাথে মোবাইলে কতা বলিচে। তার এই রিদের ছুটিতে বাড়ি আসার কতা ছিল।  আসলু কিন্তু লাশ হয়ি। ’

বাবা মোহাম্মদ ওলিউল্লাহ জানান, `আমার মাটে কোন জমি নেই।  মাত্র ২ কাটা ভিটি জমি আচে।  পরের জমি বর্গা নিয়ি চাষ করি খাই।  দুই ছেলি সংসারের হাল ধরলিও ছোট ছেলি রনি বেশি টেকা দিতু।  সে মরি যাওয়াতে আমরা অসহায় হয়ি পড়িচি।  কোম্পানি থেকি ক্ষতিপূরণের দাবি করচি।’

বড় বোন লাইলী খাতুন জানান, অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে গত ৯ মাস আগে আমার ভাই রনি চাকরি করতে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে যায়।  আজ লাশ হয়ে বাড়ি ফিরলো।  আমি আমার ভাইয়ের হত্যাকারিদের শাস্তির চাই।  তার মৃত্যুর ক্ষতিপূরণ চাই।

ঘটনার দিন বেঁচে যাওয়া রনির দুই সহকর্মী একই গ্রামের সোহাগ হোসেন ও রুবেল হোসেন জানান, ঘটনার দিন আমরা ১০টি দাবি নিয়ে আন্দোলন করছিলাম।  পরে কিছু বহিরাগত মানুষ আমাদের উপর হামলা চালায়।  পুলিশ এসে আমাদের উপর লাঠি চার্জ করে ও গুলি ছোঁড়ে।  এসময় একটি গুলি রনির মাথায় লাগে। তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সের নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষনা করেন।

গ্রামের প্রতিবেশী শফিকুল ইসলাম জানান, রনি খুব শান্ত ও ভদ্র ছেলে ছিলো।  সে অন্যদের থেকে অনেক আলাদা ছিল।  আমরা চাই রনির পরিবারকে কোম্পানি ও সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া হোক।

উল্লেখ্য, গত ১৭ এপ্রিল শনিবার দুপুরে চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার গন্ডামারা এলাকায় কয়লাবিদ্যুত কেন্দ্রে শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে শ্রমিক-পুলিশ ও এলাকাবাসীর মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষে ৫ জন নিহত এবং অন্তত ১২ জন আহত হন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More