চুয়াডাঙ্গায় বাড়ছে সামাজিক সংক্রমণ : মেহেরপুরে একজন  ঝিনাইদহে পুলিশ-র‌্যাব সদস্যসহ ২৪ জনের করোনা শনাক্ত

স্টাফ রিপোর্টার: চুয়াডাঙ্গায় নতুন করে ১১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে নতুন করোনা রোগী। সাধারণ মানুষের উদাসিনতার কারণে দিন দিন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিধি না মানার কারণে গত তিন দিনে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ৩০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। নতুন আক্রান্তরা পরিবারের ও প্রতিবেশীদের অন্য পজেটিভ সদস্যদের মাধ্যমে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার ফলে সামজিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস। সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব না হলে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করবে। সামাজিক দূরত্ব ও মাস্ক না পরার প্রবণতা মানুষের মাঝে বেশি দেখা যাচ্ছে। দিনের বেশির ভাগ সময় মানুষ স্বাভাবিকভাবে চলাচল করছে। সদর হাসপাতালের আইসোলেশন নারী ওয়ার্ডে ভর্তি একজন রোগী মানসিক ভেঙে পড়ায় ৬ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সিভিল সার্জন, আবাসিক মেডিকেল অফিসার ও ওয়ার্ড বয় বুঝিয়ে তাকে স্বাভাবিক করেন। চুয়াডাঙ্গায় নতুন করে ১১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস পজেটিভ হয়েছে। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পিসিআর ল্যাব থেকে চুয়াডাঙ্গার ৪১টি রিপোর্ট আসে সিভিল সার্জন অফিস কার্যালয়ে। করোনা আক্রান্ত হয়েছে ২৬৯ জন। অপরদিকে, মেহেরপুরের গাংনীতে আরও একজনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। ঝিনাইদহে নতুন করে পুলিশ ও র‌্যাবের তিন সদস্যসহ ২৪ জনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩১৯ জনে।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন অফিসসূত্রে জানা যায়, তিন দিনে জেলায় ১১৩ জনের মধ্যে ৩০ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার নতুন করে ১১ জনের শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। সদর উপজেলায় ৪ জন, দামুড়হুদায় দুজন ও আলমডাঙ্গায় ৫ জন। দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গায় করোনা আক্রান্ত একজন স্বাস্থ্য সহকারীর মা ও তার ৬ বছর বয়সের মেয়ে পজেটিভ হয়েছে। তারা বর্তমানে বাড়িতে থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন। চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার পৌর এলাকার মালোপাড়ার আরা হালদার নামের এক ব্যক্তি ঢাকায় চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় করোনা আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকালে মারা যান। আরা হালদারের সাথে স্ত্রী ও বোন জামাই ছিলেন। তাদের দুজনকে প্রথমে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডের হলুদ জোনে ভর্তি রাখা হয়। তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হলে রিপোর্ট পজেটিভ হয়। দুজনকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে রাতেই। আরা হালদারের বোন জামাইয়ের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলার খালিশপুর এলাকায়। কোটালি কমিউনিটি ক্লিনিকের কমিউনিটি হেলথ্ কেয়ার প্রোভাইডার এক নারী সদস্য করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। ওই নারীর ঘ্রাণ শক্তি হ্রাস পায় ও কাশি ছিলো। তিনি সোমবার সকালে নমুনা দেন। শহরের সিনেমাহল পাড়ার ৫৫ বছর বয়সের এক ব্যক্তি গাজিপুরে স্পিনিং মিলে চাকরি করতেন। তিনি সোমবার সকালে গাজিপুর থেকে অসুস্থ অবস্থায় বাড়ি ফিরে সদর হাসপাতালে নমুনা দেন। গতকাল মঙ্গলবার রাতে তার রিপোর্ট করোনা পজেটিভ আসে। তিনি বর্তমানে সদর হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন। আলমডাঙ্গা উপজেলার রাধিকাগঞ্জ গ্রামের স্বামী ও স্ত্রী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলো রোববার। তাদের সংস্পর্শে এসে মঙ্গলবার নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন মেয়ে ও নাতি ছেলে। আলমডাঙ্গা শহরের মিয়াপাড়ার ৩৭ বছর বয়সের একজন উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার করোনা পজেটিভ হয়েছেন। তিনি যশোর জেলার কেশবপুর উপজেলায় কর্মরত আছেন। তিনি সেখানে কয়েক দিন আগে একজন করোনা পজেটিভ রোগীর সংস্পর্শে আসার পর জ্বর ও কাশি দেখা দেয়। বাড়ি ফিরে এসে তিনি করোনা পরীক্ষার জন্য হারদী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নমুনা দিলে রিপোর্ট পজেটিভ আসে। বর্তমানে তিনি বাড়িতে আছেন। হারদী গ্রামের ৬০ বছর বয়সের ও গড়চাপড়া গ্রামের ৬৫ বছর বয়সের দুই নারী করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। নতুন আক্রান্তদের মধ্যে ৩ জন প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রয়েছেন, বাকিরা নিজ বাড়িতে আছেন।
নতুন আক্রন্তরা সামাজিকভাবে করোনা পজেটিভ হচ্ছে। তারা পরিবার অথবা প্রতিবেশীদের সংস্পর্শে আসার পর করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার তিন রেড জোন এলাকায় লকডাউনের সুফল পাচ্ছেন স্থানীয়রা। জীবননগর পৌর এলাকার ৪টি ও দর্শনা পৌর এলাকার ৩টি ওয়াড রেড জোন হিসাবে চিহিৃত করে আংশিক লকডাউন করা হয়। আলমডাঙ্গা উপজেলার হাড়োকান্দী গ্রাম সম্পূর্ণ লকডাউন করার পর নতুন কোনো রোগী শনাক্ত হয়নি। রেড জোন এলাকার মানুষ লকডাউন যথাযথভাবে মেনে চলায় করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছে। আর জীবননগর পৌর এলাকার লকডাউন ওয়ার্ডগুলোতে নতুন কেউ আক্রান্ত হয়নি কয়েক দিনে। এক সপ্তাহে জীবননগরে কারো শরীরে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়নি। এখানকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। দর্শনাতে আগের চাইতে এখন নতুন রোগী হ্রাস পেতে শুরু করেছে।
চুয়াডাঙ্গায় এ পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ২৬৯ জন। সুস্থ হয়েছেন নতুন ৪ জন। এ পর্যন্ত ১৬৯ জন রোগী সুস্থ হয়েছেন। করোনা পরীক্ষার জন্য নতুন নমুনা প্রেরণ করা হয়েছে ৫০টি। করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তিনজন। হোম ও প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে রয়েছেন ৯৫ জন রোগী। আর দুজন রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে ৪ জন ও হোম কোয়ারেন্টাইনে রয়েছেন ৪৭৮ জন।
সিভিল সার্জন এএসএম মারুফ হাসান বলেন, বেশ কিছু দিন ধরে সামাজিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে করোনা ভাইরাস। ব্যক্তি সচেতনতা ছাড়া প্রতিরোধ সম্ভব না। মানুষ স্বাস্থ্য বিধি সম্পর্কে উদাসিন। বেশির ভাগ মানুষের মুখে মাস্ক দেখা যাচ্ছে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় থাকছে না। মানুষকে বোঝানোর পরও সচেতন হচ্ছে না। এভাবে করোনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। করোনা পজেটিভ সদস্যদের মাধ্যমে পরিবার ও প্রতিবেশীরা সংক্রমিত হচ্ছে। আইনের প্রয়োগ বেশি হলে মানুষ আবার সচেতন হতে পারে। তা না হলে জেলার করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে অগ্রসর হবে। স্বাস্থ্য বিধি মানা ছাড়া কোনো উপায় নেই। তিন দিনে ৩০ জন করোনা আক্রান্ত হয়েছে।
গাংনী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলায় গতকাল নতুন করে একজন করোনায় আক্রান্ত ও মুজিবনগরে একটি ফলোআপ পজেটিভ। গতকাল মঙ্গলবার রাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মেহেরপুরের সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দিন। আক্রান্ত ব্যক্তি হলেন গাংনী উপজেলার কাজীপুর গ্রামের কলেজপাড়ার জাহিদুল ইসলাম। গাংনী উপজেলা প্রশাসন জাহিদুল ইসলামের বাড়ি লকডাউনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সিভিল সার্জন ডা. নাসির উদ্দিন জানান, করোনা ভাইরাস সন্দেহে সোয়াব পরীক্ষার জন্য যে নমুনা পাঠানো হয়েছিলো তার মধ্যে আরও ২১ জনের রিপোর্ট এসেছে। যার মধ্যে দুটি পজেটিভ ও বাকি ১৯ জনের নেগেটিভ। নতুন পজেটিভ একটি গাংনী উপজেলার ও মুজিবনগর উপজেলার একটি ফলোআপ পজেটিভ। এ সকল রিপোর্ট কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেয়া হয়। এ নিয়ে মেহেরপুর জেলায় ১ হাজার ৯৯১জনের মধ্যে ৯৫টি পজেটিভ। এর মধ্যে ৩৬ জন সুস্থ হয়েছেন। মৃত্যুবরণ করেছেন ৫ জন।
ঝিনাইদহ অফিস জানিয়েছে, ঝিনাইদহে নতুন করে পুলিশ ও র‌্যাবের তিন সদস্যসহ ২৪ জনের করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এ নিয়ে জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ৩১৯ জনে। নতুন করে আক্রান্তদের মধ্যে রয়েছেন সদর উপজেলায় ১৩ জন (এর মধ্যে দুজন পুলিশ সদস্য ও একজন র‌্যাবের আনসার সদস্য), কালীগঞ্জ উপজেলায় ৯ জন, শৈলকুপা উপজেলায় একজন ও মহেশপুর উপজেলায় একজন। গতকাল মঙ্গলবার সকালে ঝিনাইদহ থেকে পাঠানো ৬০টি নমুনার মধ্যে ৩৬টি নেগেটিভ ও ২৪টি রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। ঝিনাইদহ সিভিল সার্জন ডা. সেলিনা বেগম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, নতুন করে আক্রান্ত সবাইকেই স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে হোম আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। জেলায় এ পর্যন্ত আক্রান্ত ৩১৯ জনের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১১৪ জন। মারা গেছেন শৈলকুপায় দুজন ও কালীগঞ্জে ৩ জন। এদিকে শৈলকুপায় করোনার উপসর্গ নিয়ে রাকিবুল ইসলাম (৩৭) নামের এক ব্যক্তির মারা গেছে বলে জানা গেছে। নিহতের বাবা খেলাফত জোয়ার্দ্দার জানান, প্রায় ১ সপ্তাহ ধরে রাকিবুল ইসলাম ঠা-া ও জ¦রে ভুগছিলো। গত সোমবার সন্ধ্যায় তাকে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে ভর্তি করলে মঙ্গলবার সকালে হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় সে মারা যায়। আবার ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলায় মঙ্গলবার নতুন করে ৪ পুলিশ সদস্যসহ মোট ৯ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ১০৮ জনে। যার মধ্যে মারা গেছে তিনজন ও সুস্থ হয়েছেন ৩৮ জন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন কালীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. সুলতান আহমেদ। ডা. সুলতান আহমেদ আরও জানান, মঙ্গলবার সকালে নতুন করে ২৫টি নমুনার রিপোর্ট এসেছে। যার মধ্যে ৯টি নমুনার রিপোর্ট পজেটিভ বাকি ১৬টি নেগেটিভ। নতুন করে বারবাজার থানা পুলিশের ৪ জন পুলিশ সদস্য, কালীগঞ্জ পৌর এলাকার নিশ্চিন্তপুর, চাপালি, খয়েরতলা, ফয়লা ও দক্ষিণ আড়পাড়া গ্রামের একজন করে মোট ৯জন আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের সকলকে বাড়িতে রেখে মোবাইলের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।
বারবাজার হাইওয়ে থানার ওসি শেখ মাহফুজার রহমান জানান, মঙ্গলবার একজন এএসআই ও তিনজন পুলিশ কনস্টেবলের রিপোর্ট করোনা পজেটিভ এসেছে। তাদের সকলকে পুলিশ স্টেশনে আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অপরদিকে ঝিনাইদহের মহেশপুরে আরও একজন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ নিয়ে এ উপজেলায় আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ালো ২০ জনে। নতুন করে আক্রান্তরা উপজেলার মান্দারতলা গ্রামে। তিনি নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে চিকিৎসাধীন আছেন। মহেশপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আঞ্জুমানার বেগম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, তার শরীর থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য যশোর বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হলে মঙ্গলবার সকালে তার করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। উল্লেখ্য, ৭ জুলাই ঝিনাইদহ জেলায় ২৪ জনের করোনা ভাইরাস পজেটিভ রিপোর্ট আসে এরমধ্যে মহেশপুরে একজন। মহেশপুরে ২০ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে ১১ জন সুস্থ হয়েছেন এবং ৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More