টাকা ছাড়া চিকিৎসা মেলে না চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে

পরিচয়পত্র গলায় ঝুলিয়ে দালালি : রোগীর মোবাইল চুরির পর ফেরত দিলো এক স্বেচ্ছাসেবক
স্টাফ রিপোর্টার: চোর ও দালালের উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের রোগী ও তাদের স্বজনরা। একদিকে দালালদের প্রতারণা আর অন্যদিকে রোগী ও রোগীর স্বজনদের টাকা, মোবাইলফোন ও গয়নাগাটি চুরির ঘটনা তো আছেই। এছাড়া হাসপাতালের জরুরি বিভাগে টাকা ছাড়া কোনো রোগী চিকিৎসা পান না বলেও রয়েছে অভিযোগ। এরই মধ্যে এক রোগীর মোবাইলফোন চুরির পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক স্বেচ্ছাসেবকের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। শনিবার চিকিৎসা নিতে জরুরি বিভাগে গেলে রোগী নুরুল ইসলামের মোবাইলফোন চুরি হয়ে যায়। পরে স্বেচ্ছাসেবক জাহিদের কাছ থেকে সেটি উদ্ধার করেন আরএমও ডা. সাজিদ হাসান। তবে মোবাইল উদ্ধার হলেও অভিযুক্ত চোরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। জাহিদের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন স্থানীয়দের অনেকেই। এতে হাসপাতালে চোর-দালালের উৎপাত বাড়তেই থাকবে বলে আশঙ্কা তাদের।
অভিযোগ রয়েছে টাকা ছাড়া চিকিৎসা মেলে না চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। চিকিৎসা প্রদানের আগেই রোগীর স্বজনদের সাথে করা হয় চুক্তি। আশঙ্কাজনক বা সঙ্কটাপন্ন রোগীদের কিছুটা ছাড় দেয়া হলেও কোনোভাবেই নিস্তার নেই বিষপান করা রোগীদের। বাদ পড়েন না ছোটখাটো কাটাছেঁড়া বা হাত-পা ভাঙার চিকিৎসা নিতে যাওয়া রোগীরা। প্রথমে চিকিৎসার মালামাল কেনা বাবদ এবং পরে বকশিশের নাম করে দাবি করা হয় মোটাঅঙ্কের টাকা। দাবিকৃত টাকা না দিলে রোগী ও তাদের স্বজনদের কাছ থেকে অনেকটা জোর করেই টাকা হাতিয়ে নেন সেচ্ছাসেবকরা। এ নিয়ে এর আগে রোগীর স্বজনদের মারধরের ঘটনাও ঘটেছে।
এছাড়া রোগী ভাগিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে স্বয়ং স্বেচ্ছাসেবকদের বিরুদ্ধেও। এমনকি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে নিজের ইচ্ছেমতো রোগীর পরীক্ষা নিরীক্ষাও করেন তারা। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের বর্তমান চিত্র এমন হলেও তা দীর্ঘদিনের নয়। মাসছয়েক আগে কাজ করার সুযোগ পাওয়া ২০জন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জরুরি বিভাগে দায়িত্ব পালন শুরু করার পর থেকেই বদলে যেতে থাকে চিত্র। কিছুদিনের মধ্যেই রূপ নেয় বর্তমান অবস্থায়।
স্থানীয় কয়েকজন বলেছেন, হাসপাতাল এলাকায় এখন আর কোনো দালাল দেখা যায় না। কেননা একসময়ের চিহ্নিত কতিপয় দালালই এখন কার্ডধারী স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। রোগী ভাগিয়ে বিভিন্ন ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে গেলেও তাদের দালাল হিসেবে আইনের আওতায় নেয়া সম্ভব হয় না।
এদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সুপারিশে জরুরি বিভাগে কাজের সুযোগ পাওয়া স্বেচ্ছাসেবকরাই বেশি বেপরোয়া। তাদের হাতে জিম্মি হয়ে রয়েছে অন্যসব স্বেচ্ছাসেবক। এমনটাই মন্তব্য করে স্বাস্থ্য বিভাগের কয়েকজন বলেছেন, ওদের কাজকর্ম দেখে খারাপ লাগলেও কিছু বলার নেই। আমাদেরও ভয় আছে; ওদের বিরুদ্ধে কথা বলে জখম হওয়ার ইচ্ছে নেই।
জরুরি বিভাগে চিকিৎসা প্রদানের সময় রোগীর মোবাইলফোন চুরির বিষয়ে আরএমও ডা. সাজিদ হাসান বলেন, গত শনিবার চুয়াডাঙ্গা পৌর এলাকার শান্তিপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসলাম চিকিৎসা নিতে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে আসেন। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা প্রদানের সময় তার মোবাইফোনটি চুরি হয়ে যায়। পরে জরুরি বিভাগের স্বেচ্ছাসেবক জাহিদের কাছ থেকে মোবাইলটি উদ্ধার করা হয়।
হাসপাতালসূত্রে জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২৪ ঘন্টায় তিন শিফটে ১৫জন দায়িত্ব পালন করতো। প্রত্যেক শিফটে ছিলো দু’একজন সরকারি কর্মচারী এবং স্বেচ্ছাসেবক। মাসছয়েক আগে নতুন করে আরও প্রায় ২০ জনের কাজের সুযোগ দেন তৎকালীন আরএমও ডা. শামীম কবীর। তিনি পদোন্নতি পেয়ে ঝিনাইদহে বদলি হওয়ার আগ মুহূর্তে বিভিন্ন সুপারিশ ও পূর্বের আবেদনের প্রেক্ষিতে ওই ২০ জনের পরিচয়পত্র প্রদান করেন।
নতুন ২০ জনের মধ্যে রয়েছে চিহ্নিত দালালসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা-ে জড়িত ব্যক্তিরাও। তারা স্বেচ্ছাসেবকের পরিচয়পত্র গলাই ঝুলিয়ে হাসপাতাল এলাকায়ই নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছে অপরাধমূলক কাজ। কমিশনের লোভে কৌশলে রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। প্রয়োজন না হলেও সহজ সরল রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সহযোগিতা করার নাটকে রোগীদের বোকা বানিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে টাকা। নতুন ২০জনের তালিকায় রয়েছে মোবাইল চুরির ঘটনায় জড়িত স্বেচ্ছাসেবক জাহিদ। তার বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে। বেপরোয়া আচরণ ও চিকিৎসা প্রদানে অর্থবাণিজ্যের আরও অভিযোগ রয়েছে সেচ্ছাসেবক সুমনের বিরুদ্ধে। এমনকি বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে রোগী স্থানান্তরের ভাড়াও নির্ধারণ করে দেয় তারা।
সম্প্রতি পেটে ব্যথা নিয়ে চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান এক যুবক। চিকিৎসক তাকে দেখে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। ওয়ার্ডে যাওয়ার আগেই সেচ্ছাসেবক কার্ডধারী এক যুবক এসে কৌশলে ওই রোগীকে নিয়ে হাসপাতাল সড়কের গ্রিন লাইফ মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যান। চিকিৎসক কোন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরামর্শ না দিলেও সেখানে ওই রোগীর বেশকয়েকটি পরীক্ষা করানো হয়। রোগী ভাগিয়ে নিয়ে যাওয়া হাসপাতালের কার্ডধারী ওই যুবকের নাম জাহিদ। সে জরুরি বিভাগে সেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্মরত। এদিকে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ইচ্ছেমতো রোগীর পরীক্ষা করানোর বিষয়টি জানতে পেরে ওই ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে টাকা দাবি করেন সুমন নামের অপর এক স্বেচ্ছাসেবক। দর কষাকষির এক পর্যায়ে সুমন ৫ হাজার টাকা নেন বলেও জানা যায়।
কিছুদিন আগে বিষপান করা গৃহবধূ রাশিদার চিকিৎসার জন্য তাকে হাসপাতালে নেয় স্বজনরা। গৃহবধূ রাশিদার পাকস্থলি পরিস্কার (বিষ ওয়াশ) করার জন্য দেড় হাজার টাকা দাবি করেন এক স্বেচ্ছাসেবক। সরকারি হাসপাতালে বিষ ওয়াশ করতে দেড় হাজার খরচ কেন জানতে চাইলে ওই স্বেচ্ছাসেবকের সাথে রোগীর স্বজনের বাকবিত-া শুরু হয়। একপর্যায়ে রোগীর ওই স্বজনকে মারধরও করা হয়।
চুয়াডাঙ্গা শহরের ঈদগাহপাড়ার শেখ জাহিদুর রহমান অভি বলেন, কিছুদিন আগে খেলতে গিয়ে আঘাত লাগার কারণে আমার শিশুকন্যাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। মেয়ের মুখে দুইটি সেলাই দিতে হবে জানিয়ে সুতো কেনার জন্য আমার কাছ থেকে ৩শ’ টাকা নেয় জরুরি বিভাগের লোকজন। ৩শ’ টাকা দিয়ে কেনা সুতো দিয়ে মাত্র দুইটি সেলাই দেয়া হয়। আদৌ সুতো কিনেছিলো কিনা তাও জানি না। এরপর আবার আমার কাছে বকশিশ দাবি করেন। তারা বলে, খুশি হয়ে আপনার যা ইচ্ছে তা-ই দেন। পরে তাকে মোট ৫শ’ টাকা দিই। খেলতে গিয়ে দুর্ঘটনার কারণে আমার মেয়ে আঘাত পেয়েছে, এটা কী খুশি হওয়ার মতো কোন ঘটনা?
শনিবার বেলা ১২টার দিকে শহিদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, অসুস্থ শরীর নিয়ে হাসপাতালে এসে দেখি জরুরি বিভাগটি বন্ধ। আশেপাশের লোকজনের কাছে জানতে পারি জরুরি বিভাগ নতুন ভবনে স্থানান্তর করা হয়েছে। নতুন ভবনের সামনে গিয়ে একজন বলে সামনে যান, আরেকজন বলে পেছনে যান। অথচ স্থান পরিবর্তনের কোন সাইনবোর্ড লাগানো নেই। সাইনবোর্ড থাকলে আমি হয়রানির শিকার হতাম না।
অপর এক রোগীর স্বজন বলেন, রোগীকে প্রথমে হাসপাতলে জরুরি বিভাগে নেয়া হয়। জরুরি বিভাগের চিকিৎসার পর ভর্তির জন্য রোগীকে ওয়ার্ডে নিতে হয়। অথচ হাসপাতালের নতুন ভবন থেকে রোগী ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ সময় অনেকই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে টাকা হাতানোর চেষ্টা করে।
দীর্ঘদিন ধরে জরুরি বিভাগে কর্মরত এক স্বেচ্ছাসেবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে জরুরি বিভাগে রোগীদের সেবা দিয়ে আসছি। কখনও কারও কোন রোগীর কাছ থেকে জোরপূর্বক টাকা আদায় করিনি। বর্তমানে আমাদের সাথেই যারা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছে, তারা এক প্রকার জুলুম করেই টাকা করে। সবকিছু দেখে খারাপ লাগলেও দা’র ভয়ে কিছুই বলতে পারিনা।
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. সাজিদ হাসান বলেন, হাসপাতালে ১০টি ট্রলি আছে। এর মধ্যে কিছু ট্রলি অকেজো হয়ে রয়েছে এবং কিছু মেরামত করা হয়েছে। ট্রলি বহনের জন্য হাসপাতালে কোন কর্মি নেই। মূলত কেউ ট্রলি নিয়ে যাওয়ার পর যথাস্থানে রেখে যায় না, ফলে জরুরি বিভাগে ট্রলি থাকে না। এছাড়া পুরাতন জরুরি বিভাগের স্থান পরির্বতনের সাইনবোর্ড খুবই দ্রুত লাগানো হবে বলেও জানান তিনি।
মোবাইল চুরির বিষয়ে আরএমও ডা. সাজিদ হাসান বলেন, জরুরি বিভাগের স্বেচ্ছাসেবকেদের মাধ্যমে জানতে পারি জাহিদ নামের অপর এক স্বেচ্ছাসেবক রোগী নুরুল ইসলামের মোবাইলফোটি চুরি করেছে। তবে জাহিদ হাসপাতালে না থাকায় তার সাথে মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করি। সে সময় চুরির বিষয়টি অস্বীকার করে সে। তাকে কোনো শাস্তি দেয়া হবে না বলে জানিয়ে মোবাইলফোনটি ফেরত দেয়ার জন্য বলা হয়। পরে মোবাইলটি নিয়ে আসে জাহিদ। এক ইজিবাইক চালকের কাছ থেকে মোবাইলফোনটি পেয়েছে বলেও জানায় সে। তবে ইজিবাইক চালকের কাছে থেকে তার হাতে কিভাবে গেলো, ইজিবাইক চালকের পরিচয় কী জানতে চাইলে কিছুই বলতে পারেনি জাহিদ। পরে মোবাইলফোনটি নুরুল ইসলামকে ফেরত দেয়া হয়।
স্বেচ্ছাসেবকদের দৌরাত্মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, যত দ্রুত সম্ভব তাদের লাগাম টেনে ধরা হবে। চিকিৎসা দিতে গিয়ে হাসপাতালের কোন স্টাফ বা স্বেচ্ছাসেবকের অনিয়ম দুর্নীতি মেনে নেয়া হবে না।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More