বসন্তে রঙিন ভালোবাসার দিন আজ

আনন্দে মাতবে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ

আলম আশরাফ: চির নবীন বসন্তের প্রথম দিন আর চিরায়ত সুন্দরের প্রতীক ভালোবাসার বিশেষ দিবসটি উৎসবের রঙ ছড়িয়ে হাতে হাত ধরে মিলেমিশেই এসেছে আরও একবার। পাতাঝরা দিন ভালোবাসার ডাক দিয়ে যায়। মনের অজান্তে ভেতর থেকে ভেসে আসে কবি নির্মলেন্দু গুণের লেখা কবিতার লাইনগুলো: ‘হয়তো ফোটেনি ফুল রবীন্দ্র-সংগীতে যতো আছে,/হয়তো গাহেনি পাখি অন্তর উদাস করা সুরে বনের কুসুমগুলি ঘিরে।/আকাশে মেলিয়া আঁখি তবুও ফুটেছে জবা,/দুরন্ত শিমুল গাছে গাছে,/তার তলে ভালোবেসে বসে আছে বসন্তপথিক।’

কিংবা কবি জীবনানন্দ দাশের মতো প্রেমিক হৃদয় বলে উঠবে: ‘হৃদয়, তুমি সেই নারীকে ভালোবাসো, তাই/আকাশের ওই অগ্নিবলয় ভোরের বেলা এসে/প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছে অমেয় কাল হৃদয় সূর্য হবে/তোমার চেয়েও বেশি সেই নারীকে ভালোবেসে।’ আজ বসন্ত রাঙানো ভালোবাসার দিন। কোকিলের কুহুতানে জাগা মুখরিত বাংলার বিস্তীর্ণ প্রান্তরে আজ পয়লা ফাগুনের দিনে হবে ভালোবাসার জয়গান। হৃদয় থেকে হৃদয়ের কথাগুলো আজ ভাষা পাবে। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে কিংবা প্রেমিকা তার প্রেমিককে আমি তোমাকে ভালোবাসি কথাটি প্রকাশ করবে ‘হ্যাপি ভ্যালেনটাইন’স ডে’ উচ্চারণ করে।

ঋতুরাজের আগমনে কোকিলের কুহুতানে প্রকৃতিতে বসন্তের বাতাস উজ্জীবিত করবে বসন্তপ্রিয় বাঙালিকে। আগুনলাগা ফাগুনের সঙ্গে ভালোবাসার লালে রাজপথে নামবে বাসন্তী ভালোবাসার মিছিল। হিমেল শীতের আড়মোড়া ভেঙে পুরোনো পাতা ঝরে গিয়ে বৃক্ষরাজিতে নতুন পত্রপল্লবে বসন্ত যেভাবে প্রকৃতিতে সৌন্দর্যের চাদর বিছিয়েছে, ঠিক তেমনি ফাল্গুনী রঙের বসনের সঙ্গে ফুলের চাদর গায়ে দিয়ে কপোত-কপোতীদের পরানের গহিন থেকে উচ্চারিত হবে ভালোবাসার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি। হলুদ-কমলার বাসন্তী আবিরের সঙ্গে ভালোবাসার লাল গোলাপে রাজপথ থেকে গলিপথে ছড়িয়ে পড়বে বাসন্তী দিনের ভালোবাসা। ফাস্ট ফুডের দোকান, ফুটপাতের চটপটি-ফুচকার দোকানেও বিনিময় হবে অনুভূতির ডালপালা। লাল-হলুদ শাড়ি অঙ্গে জড়িয়ে হলুদ গাঁদা আর লাল গোলাপের অনিন্দ্য সৌন্দর্যের সঙ্গে বসন্তের দিনে তরুণীরা যেভাবে ভালোবাসার উষ্ণতা ছড়াবে, ঠিক তেমনি বসন্তের হাওয়ায় মিশে ভালোবাসার উত্তাপে পাঞ্জাবি আর ফতুয়ায় তরুণরাও একাকার হয়ে যাবে। বসন্ত মানেই পূর্ণতা। বসস্ত মানেই নতুন প্রাণের কলরব। কচিপাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালির মনেও লাগবে দোলা। বিপুল তরঙ্গ প্রাণে আন্দোলিত হবে বাঙালি মন। শুধু শহরেই নয়, বাংলার গ্রামীণ জনপদেও আজ ঝিরিঝিরি বাতাসে ধরা দেবে বসন্ত। বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস এসেছে হাত ধরাধরি করে। তাই বসন্তবরণ ও ভালোবাসা দিবস পালন করা হচ্ছে একই দিনে।

ঋতুরাজ বসন্ত বরণে আনন্দে মাতবে তরুণ-তরুণীসহ নানা বয়সের মানুষ। বসন্ত আর ভালোবাসায় একাকার দিন। বসন্ত বরণ আর ভালোবাসা দিবস উদ্যাপনে তাই দিকে দিকে নানা আয়োজন। বাসন্তী রঙের শাড়িতে সাজবে তরুণীরা। মাথায় গুঁজবে বাহারি ফুল। একইসঙ্গে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জানানোর অন্যতম উপকরণ ফুল। প্রেমিক তার প্রেমিকাকে উপহার দেবে লাল গোলাপ তাই ফুলের বাজারে ঘুরছেন মানুষ। আর এই দুইটি দিবস ঘিরে দেশের হাট-বাজারে ফুলের পসরা নিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বেড়ে গেছে ফুলের দামও।

বসন্ত ও ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর সারাদেশ আজ মেতে উঠবে ফাল্গুনী আমেজে। ফাগুনের আগুনলাগা উচ্ছ্বাস প্রিয়তমের হাতে হাত রেখে প্রিয়ার কোমল হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠবে ঘরবাঁধার স্বপ্নে। ঋতুরাজের দখিনা বাতাস তাদের হৃদয়-জমিনে ভালোবাসার ঢেউ তুলবে। বাসন্তী রঙের শাড়িতে খোঁপায় হলুদ গাঁদা আর মাথায় ফুলের টায়রার সুষমার শৈল্পিকতা ফুটে উঠবে তরুণীদের। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তরুণরাও কম যাবে না। তরুণরাও ধরা দেবে হলুদ পাঞ্জাবিসমেত একরাশ ফাল্গুনী সাজে।

চুয়াডাঙ্গা শহরের ফুলের দোকানিগুলোতে বাহারি সব ফুল দিয়ে পসরা বসিয়েছেন। এসব দোকানেও ক্রেতারা ভিড় করেন ফুল কেনার জন্য। পয়লা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে কদর বেড়েছে সব ধরনের ফুলের। এ জন্য দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। অন্য সময় ১০ টাকায় বিক্রি হওয়া একটি লাল গোলাপের দাম হাকানো হচ্ছে ৫০ টাকা। তবুও ভালোবাসার মানুষের জন্য ফুল কিনতে দোকানে দোকানে ভিড় জমাচ্ছেন ক্রেতারা। ব্যস্ত সময় পার করতে দেখা যায় ফুল ব্যবসায়ীদের। এতে করে ফুল বেচাকেনার জন্য নির্ধারিত স্থানের সীমানা পেরিয়ে ফুটপাতেও নানা রঙের ফুল বিক্রি করতে দেখা যায়।

ফুলের দোকানিরা জানান, ফেব্রুয়ারি আর মার্চ মাস ফুল বিক্রির মরসুম। এই সময়ে সব ধরনের ফুলের চাহিদা থাকে। এই দুই মাসে দেশে অনেক অনুষ্ঠান হয়। এসব অনুষ্ঠানের জন্য অনেক ফুলের প্রয়োজন হয়। পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে এই চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই দামও অন্য সময়ের চেয়ে বেশি হয়। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে প্রিয়জনের জন্য লাল গোলাপ সংগ্রহ করতে চায় সবাই। কিন্তু দ্রব্যমূল্যের এমন ঊর্ধ্বগতির আঁচ এবার পড়েছে ফুলের বাজারে। প্রতিটি গোলাপ বিক্রি হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা দামে। ক্রেতা কম, কৃষকরা বেশি দামে বিক্রি করছেন, উৎসবের সময় দাম বাড়ার-এসবকেই দাম বাড়ার কারণ বলছেন তারা।

বাড়তি দাম প্রসঙ্গে ফুল দোকানের বিক্রেতারা বলেন, বাড়তি দাম দিয়ে কিনে আনায় বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। এবারের বিক্রি এখনো শুরু হয়নি, আশা করছি কাল (আজ) থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ফুলের চাহিদা ভালোই থাকবে।তারা আরও বলেন সারা বছর বিয়েও সামাজিক অনুষ্ঠানে ফুল বিক্রি হয়। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে কিছু দিন খুব বেশি বিক্রি হয়। এজন্য বিক্রেতারা একটু চড়া দামেই বিক্রি করেন।

এদিকে, বসন্তমিশ্রিত ভালোবাসার এমন দিনে পরস্পরের শুভেচ্ছায় সিক্ত হবে দুজন। ফুল, কার্ড, চকলেট বিনিময়ের পাশাপাশি কবিতা ও ছন্দমিশ্রিত ক্ষুদে বার্তায় ভরে যাবে মুঠোফোনের ইনবক্স। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ছড়িয়ে যাবে পরানের গহিনের উষ্ণতা। বিনোদন কেন্দ্র ও পার্কসহ অনেক জায়গায় ভালোবাসা দিবস এবং বসন্তের ছোঁয়া থাকবে।

এতোদিন পয়লা ফাল্গুনের ঠিক পরদিনই ছিলো ভালোবাসা দিবস। দুদিনব্যাপী এই উৎসব পালনের জন্য থাকে বিশাল প্রস্তুতি, রীতিমতো ঈদের মতো কেনাকাটাও শুরু হয়ে যায়। একদিন ফাগুনের রঙে হলুদ-বাসন্তী সাজ, আরেকদিন ভালোবাসার আবিরমাখা লাল টুকটুকে সাজ। ২০২০ সালে বাংলা একাডেমির নতুন করে বাংলা তারিখ প্রবর্তনের ফলে পয়লা ফাল্গুন আর বিশ্ব ভালোবাসা দিবস একই দিনে উদযাপিত হচ্ছে। উৎসব পাগল কেউ ভাবছেন দুদিনের উৎসবই ভালো ছিলো। কেউ আবার ভাবছেন এটাই ভালো, একদিনে দুই উৎসব। এখন তাই লাল-হলুদ দু’রঙে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় দিনটি। ভালোবাসা দিবস ভিনদেশী সংস্কৃতি থেকে আসলেও, ফাল্গুন একান্তই আমাদের বাঙালী উৎসব।

ইতিহাসবিদদের মতে, মোগল সম্রাট আকবর প্রথম বাংলা নববর্ষ গণনা শুরু করেন ১৫৮৫ সালে। নতুন বছরকে কেন্দ্র করে ১৪টি উৎসবের প্রবর্তন করেন তিনি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বসন্ত উৎসব। তাই বসন্ত উৎসব শুধু একটা উৎসব নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলার গৌরবময় ঐতিহ্য।

এদেিক, দুটি প্রাচীন রোমান প্রথা থেকে এ উৎসবের সূত্রপাত। এক খ্রিস্টান পাদরি ও চিকিৎসক ফাদার সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের নামানুসারে দিনটির নাম ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ করা হয়। ২৭০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি খ্রিস্টানবিরোধী রোমান সম্রাট গথিকাস আহত সেনাদের চিকিৎসার অপরাধে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদ- দেন। মৃত্যুর আগে ফাদার ভ্যালেন্টাইন তার আদরের একমাত্র মেয়েকে একটি ছোট্ট চিঠি লেখেন, যেখানে তিনি নাম সই করেছিলেন ‘ফ্রম ইওর ভ্যালেন্টাইন’। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের মেয়ে এবং তার প্রেমিক মিলে পরের বছর বাবার মৃত্যুর দিনটিকে ভ্যালেন্টাইনস ডে হিসেবে পালন শুরু করেন। ভ্যালেন্টাইনস ডে সর্বজনীন হয়ে ওঠে আরও পরে প্রায় ৪০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে একই সূত্রে গেঁথে ১৪ ফেব্রুয়ারি ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ হিসেবে উদযাপন শুরু হয়। কালক্রমে এটি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More