মৃত্যু ও সংক্রমণে ভয়ালরূপ : মধ্য জুলাইয়ে চূড়ায় উঠবে করোনা

দেশে করোনায় একদিনে দুশতাধিক মানুষের মৃত্যুর নতুন রেকর্ড

স্টাফ রিপোর্টার: করোনার ভয়াল থাবায় বিপর্যস্ত দেশ। দানবীয় রূপ নিয়েছে এ মহামারী। দিন দিন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সংক্রমণও ঊর্ধ্বমুখী। শুধু শহর নয়, জেলা-উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটি। ফলে সারা দেশেই বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্ত। প্রতি মিনিটে প্রায় আটজন করে নতুন শনাক্ত হচ্ছেন। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় প্রতি মিনিটে ৩ জনকে নেয়া হচ্ছে আইসোলেশনে। ২৭ জুন থেকে প্রতিদিন শতাধিক লোকের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে করোনা। এ পর্যন্ত মোট মৃত্যুর ১০ ভাগের ১ ভাগ হয়েছে গত ১১ দিনে। এ সময়ে ১৫৪০ জন মারা গেছেন। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে সাড়ে পনেরো হাজার। এর মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে মৃত্যু। একদিনে আক্রান্তদের মধ্যে ২০১ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা এ যাবতকালে সর্বাধিক। অঙ্কের হিসাবে প্রতি ৭ মিনিটে একজনের প্রাণ গেছে। এর আগে সোমবার সর্বোচ্চ ১৬৪ জনের মৃত্যু হয়। সবমিলিয়ে দেশে করোনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৫৯৩। গতকাল বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বমুখী হার দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা গত ২৭ জুন থেকেই শতাধিক থাকছিলো প্রতিদিন। এর মধ্যে ৪ জুলাই প্রথমবারের মতো মৃত্যুর সংখ্যা দেড় শ ছাড়িয়ে যায়। তিন দিনের মাথায় তা এক লাফে ২০০ ছাড়িয়ে গেলো। মহামারির ১৬ মাসে এক দিনে এত মৃত্যু আর কখনো দেখতে হয়নি বাংলাদেশকে। তারা বলেন, দেরিতে হাসপাতালে আনায় করোনা রোগীর মৃত্যু বাড়ছে। শয্যার অভাবে মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সব মিলে ভয়ংকর সময় পার করছে দেশের হাসপাতালগুলো। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের হার চূড়ায় উঠছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এখন অবস্থা খারাপ। জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যায়ে এই ঢেউ চূড়ায় উঠবে, তারপর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করবে। এ সময়ে চলাচল, গণজমায়েত ইত্যাদি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সারা দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যু ঊর্ধ্বমুখী। খুলনা, ঢাকা ও রাজশাহী বিভাগে রোগটি ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় খুলনা বিভাগে সর্বোচ্চ ৬৬ জনের মৃত্যু হয়। ঢাকা বিভাগের মারা গেছেন ৫৮ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, গত একদিনে দেশে ৩৭ হাজার নমুনা পরীক্ষা করে আরো ১১ হাজার ১৬২ জনের মধ্যে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়েছে। করোনা ভাইরাসের ডেলটা ধরনের ব্যাপক বিস্তারের মধ্যে এপ্রিলের রেকর্ড ভেঙে দৈনিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ৮ হাজার ছাড়ায় গত ২৮ জুন। এরপর ১ জুলাই থেকে সারা দেশে লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি হয়। এর মধ্যেই মঙ্গলবার রেকর্ড ১১ হাজার ৫২৫ জন রোগী শনাক্তের খবর আসে। এর পরদিন শনাক্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও এখনো তা ১১ হাজারের ওপরে রয়েছে। নতুন রোগীদের নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা পৌঁছেছে ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৬৮তে। তাদের মধ্যে মোট ১৫ হাজার ৫৯৩ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এ ভাইরাস।
যে ২০১ জন গত একদিনে মারা গেছেন, তাদের ৬৬ জনই ছিলেন খুলনা বিভাগের বাসিন্দা। ঢাকা বিভাগে মৃত্যু হয়েছে ৫৮ জনের। চট্টগ্রাম বিভাগে ২১ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৮ জন, বরিশাল বিভাগে ৭ জন, সিলেট বিভাগে ৯ জন, রংপুর বিভাগে ১৪ জন আর ময়মনসিংহ বিভাগে ৮ জন মারা গেছেন। কেবল ঢাকা বিভাগেই গত এক দিনে ৪ হাজার ৭৩২ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছে, যা দিনের মোট শনাক্তের ৪২ শতাংশের বেশি। খুলনা বিভাগে একদিনে শনাক্ত রোগী বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৯০০, চট্টগ্রামেও দেড় হাজারের ওপরে। সরকারি হিসাবে গত এক দিনে আরো ৫ হাজার ৯৮৭ জন সুস্থ হয়ে উঠেছে। এ পর্যন্ত মোট সুস্থ হয়েছে ৮ লাখ ৫০ হাজার ৫০২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় রোগী শনাক্তের হার ৩১ দশমিক ৩২ শতাংশ আর এখন পর্যন্ত শনাক্তের হার ১৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৮৭ শতাংশ আর শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৬০ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ২০১ জনের মধ্যে পুরুষ ১১৯ জন আর নারী ৮২ জন। এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে পুরুষ মারা গেলেন ১১ হাজার ২ জন আর নারী মারা গেছেন ৪ হাজার ৫৯১ জন। এক দিনে মৃতদের মধ্যে বয়স বিবেচনায় ষাটোর্ধ্ব রয়েছেন ১১৫ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে আছেন ৪৭ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে ২৫ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে ৯ জন, ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৪ জন আর ১১ থেকে ২০ বছরের মধ্যে রয়েছে একজন।
এদিকে দেশের চলমান লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করার ঘটনা ঘটছে। এতে করে রোগীর সংখ্যা যদি অস্বাভাবিক বেড়ে যায়, তাহলে আবারও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আয়োজিত ভার্চুয়াল বুলেটিনে এই শঙ্কা প্রকাশ করেন অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম। জানুয়ারিতে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিলো ২১ হাজার ৬২৯ জন। এপ্রিলে সেটি লাখ ছাড়িয়েছিল। জুন মাসে ১ লাখ ১২ হাজার ৭১৮ জনে থেমে ছিল আর জুলাইয়ের মাত্র সাত দিন অতিক্রান্ত হচ্ছে। সাত দিনের মধ্যে ছয় দিনে ৫৩ হাজার ১৪৮ জনকে শনাক্ত করা হয়েছে। অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘সংক্রমণের উচ্চমুখী এই প্রবণতা যদি অব্যাহত থাকে, জুলাইয়ে রোগীর সংখ্যা এপ্রিল ও জুন মাসকে ছাড়িয়ে যাবে।’
এ প্রসঙ্গে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ড. মোশতাক হোসেন বলেন, আমাদের দেশে করোনা সংক্রমণ বর্তমানে পিকে উঠতে শুরু করেছে। প্রতিটি ঢেউয়ে এটা বেড়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের চেয়ে তৃতীয় ঢেউয়ে বৃদ্ধিটা অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। তিনি বলেন, জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত এটি উঠতে পারে। তারপর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করবে। তবে ঈদের সময় যদি চলাচল নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে সংক্রমণ আরও বৃদ্ধির শঙ্কা রয়েছে। এক্ষেত্রে বেশি জোর দিতে হবে গণজমায়েত নিয়ন্ত্রণে। কারণ কোরিয়ায় করোনা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে গির্জা থেকে, ভারতে কুম্ভুমেলা থেকে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More