শরীরী শিল্পে জীবনের জয়গান

শব্দহীন, সুরহীন জীবন তো জীবন নয়। সেই কথাই যেন বলছিলেন শিল্পী আলী আজগর। পুরো শরীরের ভাষা দিয়ে, রং সেখানে একটি অনুষঙ্গ। পুরো শরীর দিয়ে ক্যানভাসে ‘গড়াগড়ি’ দিচ্ছিলেন তিনি। হাত দুটো স্থির কখনো, কখনো ধীর লয়ে এঁকে চলেছে। কিন্তু কেউ শব্দ করে উঠলে কিংবা জোরে আওয়াজ করে উঠলেই বদলে যাচ্ছে তার রেখার গতি। সুরের ছন্দে সেই রেখার ঢেউ যাচ্ছিল বদলে।

‘বডিলি ফোর আওয়ার’ শিরোনামের এই পারফর্মেন্সে শিল্পী এভাবেই যেন জীবনের চলার কথাই ব্যাখ্যা করছেন। যেন জীবন এমনই। এভাবেই সুর থাকলে, ছন্দ থাকলে জীবন গতি পায়। ছন্দহীন জীবন স্থির, ধীর। এটাকেই বলা হচ্ছে ‘পারফর্মেন্স আর্ট’।

পশ্চিমা শিল্পের উত্তর-আধুনিক একটি ধারা এই ‘পারফর্মেন্স আর্ট’। গত শতকের মধ্য ষাটের দশক থেকে যার উত্পত্তি । প্রচলিত শিল্পধারাকে উপেক্ষা করেই এ ধারার সৃষ্টি। যা সরাসরি জীবনকে স্পর্শ করতে চেয়েছে। জীবনের সমস্যাগুলোকে মানুষের সামনে তুলে আনতে চেয়েছে।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের হেড অব আর্টস ঈশিতা আজাদ বললেন, ‘এটি একটি নতুন ধারার শিল্প। শিল্পীদের বলার ধরন ভাবতে বাধ্য করে। এই শিল্পধারা মানুষের মনকে স্পর্শ করে।’

সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের বছরব্যাপি আয়োজনের অংশ হিসাবে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে এই ‘পারফর্মেন্স আর্ট’ নিয়ে কর্মশালা। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় গত তিন সপ্তাহ ধরে নানা দেশের শিল্পীরা এসে পরিচালনা করেছেন এই কর্মশালা। তারই অংশ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী নিখিল চোপড়া ও ডায়ানা ক্যাম্পবেল বেটেনকোর্ট ঢাকায় এসেছেন। ডায়ানা ক্যাম্পবেল জানালেন, ‘পারফর্মিং আর্ট’ এবং ‘পারফর্মেন্স আর্ট’ এ দুয়ের মধ্যে তফাত্ রয়েছে। পারফর্মেন্স আর্ট প্রকাশের ভাষা কেমন হবে, কিভাবে শিল্পীরা তা প্রকাশ করবে এসব নিয়ে শিল্পীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের এই শরীরী শিল্পের প্রকাশভঙ্গি নিয়েও আলোচনা করেছি। বাংলাদেশের শিল্পীরা অসাধারণ। খুব দ্রুত এই শিল্পের ভাষা তারা ধরতে পেরেছে। বাংলাদেশে এই শিল্পধারা খুব দ্রুত বিকশিত হবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

কর্মশালায় শিল্পী জুয়েল এ রবের হাতে দেখা গেল জ্বলন্ত মোমবাতি। মোম গলে গলে পুরো হাত ঢেকে গেছে। আগুনে গলে গরম মোম ধিকিধিকি আগুনের মতই জ্বলছে তার শরীরে। মানুষকেও প্রতিনিয়ত জীবন-সংগ্রামে এই ভাবেই জ্বলতে হয়। অসহায় মানুষের সেই কষ্ট, অপমানকেই মনে করাতে চাইছেন জুয়েল তার এই পারফর্মেন্স আর্ট ‘ফিল দ্য পেইন’ এ। কর্মশালায় এভাবেই নানামুখী জীবন-জিজ্ঞাসা নিয়ে শিল্পীরা উপস্থিত হয়েছিলেন শিল্পরসিকদের সামনে।

শিল্পরসিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত ফারুক সোবহান ঘুরে ঘুরে দেখলেন তরুণ শিল্পীদের এসব আয়োজন। বললেন, ‘আমাদের এই শিল্পধারার সঙ্গে যুক্ত হতে সময় লাগবে। আর্ট বলতে আমরা বুঝি পেইন্টিং, স্কাল্পচার। কিন্তু এই তরুণরা নতুন ধারার কথা বলছে। যা বাংলাদেশে নতুন। তবে তাদের কাজ এবং চিন্তার প্রসারতা প্রশংসনীয়। আমি বোঝার চেষ্টা করছি, শিল্পীরা কী বলতে চাইছে। এই জার্নিটাও ইন্টারেস্টিং।’

কর্মশালার উদ্যোক্তা সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট নাদিয়া সামদানী বললেন, আগামী বছরের ৫-৮ ফেব্রুয়ারি শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালায় ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক চিত্রকলা প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হবে। তারই অংশ হিসাবে বছরব্যাপি নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই একটি হচ্ছে এই ‘পারফর্মেন্স আর্ট’ কর্মশালা। গত তিন সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন শিল্পীরা বাংলাদেশে এসেছেন। নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেছেন। সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের শিল্পীদের দেশের বাইরেও বৃত্তি দিয়ে পাঠাচ্ছে। আর ওয়ার্কশপগুলো আয়োজনের মাধ্যমে বিদেশি শিল্পীরা কিভাবে কাজ করছেন, সেসব বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা হচ্ছে। এই ভাবনার আদান-প্রদান শিল্পীদের জন্য খুবই জরুরি বলে তিনি মনে করেন।

ww

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More