কুষ্টিয়ায় করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে : আরও ২৪ জনের মৃত্যু

অক্সিজেন মজুদ থাকলেও দাম বেড়েছে কয়েকগুণ : দেখা দিয়েছে ওষুধের সংকট
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি: আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ চাপ বেড়েছে ২৫০ শয্যার কুষ্টিয়ার জেনারেল হাসপাতালের ওপর। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল ঘোষণার পর থেকে এখানকার ২০০ শয্যায় ভর্তি করা হচ্ছে করোনা রোগী। যদিও কার্যত প্রতিদিন রোগী ভর্তি থাকছেন ৩০০-রও বেশি। এদিকে এখানে গত ১০দিনে শতাধিক রোগী মারা গেছেন করোনা ও করোনাজনিত উপসর্গ নিয়ে। এর ফলে শহরের তিনটি গোরস্তানেও চাপ বেড়েছে আগের চেয়ে। প্রতিদিন সাত-আটজন মৃত ব্যক্তিকে দাফন করতে হচ্ছে খাদেমদের। হাসপাতালের বাইরে বাড়িতেও চিকিৎসা নিচ্ছেন অসংখ্য করোনা রোগী। তারা বাড়িতেই অক্সিজেনের সিলিন্ডার কিনে ব্যবহার করছেন। এতে ব্যাপক চাহিদা বেড়েছে অক্সিজেনের; দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। অনেক সময় অতিরিক্ত দামেও মিলছে না অক্সিজেন।
কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে, ঘন ঘন অ্যাম্বুলেন্স ঢুকছে আর বের হচ্ছে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতাল থেকে। এসব অ্যাম্বুলেন্সে প্রবেশ করছে করোনা রোগী। তবে বের হওয়া অ্যাম্বুলেন্সে থাকছে লাশ। কান্নায় ভারি হয়ে রয়েছে হাসপাতাল এলাকা। গত ২৪ ঘণ্টায় এখানে নতুন করে মারা গেছেন ২৪। অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় মৃত্যু ঘটেছে একজনের। আগের দিন মারা গেছেন ১৭ জন। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের হিসাবের বাইরেও জেলার নানা জায়গায় মানুষ করোনাজনিত উপসর্গ নিয়ে মারা যাচ্ছেন। মারা যাচ্ছেন উপজেলাতেও। যাদের হিসাব নেই। অ্যাম্বুলেন্স ব্যবসায়ী মামুন জানান, অ্যাম্বুলেন্সের চাহিদা বেড়েছে। গ্রাম থেকে বেশি কল আসছে। এছাড়া লাশ নিয়ে প্রতি ঘণ্টায়ই যেতে হচ্ছে শহরের বাইরে। যেতে হচ্ছে ঢাকায় রেফার করা রোগী নিয়েও। চাহিদা ও ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়াও বেড়েছে বলে জানান তিনি।
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের কর্মী রমজান জানান, এতো রোগীর চাপ আগে কখনও দেখেননি। প্রতি ঘণ্টায় রোগী ভর্তি হচ্ছেন তিনজনেরও বেশি। কখনও কখনও একসঙ্গে ১০ জন রোগীও আসছেন। তখন রোগী বহনের ট্রলি সংকট দেখা দিচ্ছে। অক্সিজেনের স্টোরেও মিনিটে মিনিটে সিøপ হাতে রোগীর আত্মীয়স্বজন আসছেন সিলিন্ডার নিতে। এক সপ্তাহ আগেও অক্সিজেনের সংকট ছিলো শহরে। তবে এখন প্রচুর অক্সিজেন মজুদ রয়েছে। তাই চাপ সামাল দিতে বেগ পেতে হচ্ছে না।
কুষ্টিয়ার পৌর কবরস্থানের খাদেম মধু মিয়া বলেন, কোনো দিন আট, আবার কোনো দিন ১০, প্রতিদিনই এতো কবর খুঁড়তে হচ্ছে। আগে প্রতিদিন বড়জোর দুই থেকে তিনটি কবর খুঁড়তে হতো। আবার কোনো দিন খালি খালি বসে থাকতে হতো। এখন একদ- বসে থাকার উপায় নেই। পৌর কবরস্থানের বাইরে চাঁদাগাড়া ও জুগিয়া গোরস্তানেও দাফন বেড়েছে। এভাবে চললে জায়গা সংকটের আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে বর্ষা মরসুম হওয়ায় কবর খুঁড়তে বেগ পেতে হচ্ছে। বেশির ভাগ কবরেই পানি উঠছে। শহরের একমাত্র মহাশ্মশানেও বেড়েছে সৎকারের সংখ্যা। কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘হঠাৎ করেই মৃত্যু বেড়েছে। প্রায় প্রতি ঘণ্টায়ই কেউ না কেউ মারা যাচ্ছেন। এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিনই মারা যাচ্ছেন ১০-এর বেশি মানুষ। মানুষ হাসপাতালে আসছে বাড়িতে চিকিৎসা নিতে নিতে অবস্থা অনেক খারাপ হওয়ার পর, অপিজেন লেভেল অনেক নিচে নেমে গেলে। তিনি বলেন, তিনটির বেশি ওয়ার্ডে এখন সেন্ট্রাল অপিজেন চালু করা হয়েছে। প্রচুর সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে। তবে ওষুধ সংকট রয়েছে।’
জেলা শহরের সবকটি অপিজেন সিলিন্ডার বিক্রির দোকানেই এখন উপচেপড়া ভিড়। কারণ বাড়িতে চিকিৎসারত অনেকেরও অপিজেন লাগছে। তারা বাইরে দোকান থেকে অপিজেন কিনছেন। কোনো কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন অনেক সময় ফ্রি সার্ভিস দিচ্ছে। দোকান মালিক আক্তারুজ্জামান লাবু জানান, অপিজেনের চাহিদা কয়েকগুণ বেড়েছে। মিনিটে মিনিটে ফোন আসছে অপিজেনের জন্য। দামও আগের তুলনায় বেড়েছে।
হাসপাতালে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা বলছেন, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আকরামুজ্জমান মিন্টু বলেন, ‘সাত-আটদিন ধরে রোগীরা আসছেন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে। অনেকে বাড়িতে সাত-আট দিন আইসোলেশনে থাকার পর অবস্থা সাংঘাতিক খারাপ হওয়ার পর বলতে গেলে শেষ সময়ে আসছেন। বেশির ভাগেরই অপিজেন লেভেল তখন আশির নিচে। চিকিৎসকদের ওই সময় কিছুই করার থাকছে না।’
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মোমেন বলেন, ‘প্রতিদিনই ৪০-৫০ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। করোনামুক্ত হচ্ছেন এর অর্ধেকেরও কম।’ তিনি জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়েছে। তবে সেগুলো অন দ্য ওয়ে। সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য মতে, গত এক সপ্তাহে কুষ্টিয়ায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১০০ জন। যাদের অধিকাংশের বাড়িই গ্রামে। একই সময়ে উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও ২৯ জন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More