নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় বিভিন্ন স্থানে পানিবন্দি অনেক পরিবার

চুয়াডাঙ্গায় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৩৯ মিলিমিটারসহ দেশে ২ হাজার ৫১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড

স্টাফ রিপোর্টার: ভারতের উপকূলে অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপটি বর্তমানে দুর্বল হয়ে সুস্পষ্ট লঘুচাপের আকার ধারণ করেছে। এর প্রভাবে সারাদেশে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে। এদিকে, চুয়াডাঙ্গায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। যা এ বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। প্রবল বৃষ্টির কারণে মাঠঘাট, পুকুর সব পানিতে থৈ থৈ করছে। এছাড়া পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন অনেক এলাকার মানুষ। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি কিছুটা কমতে থাকে। অতিমাত্রায় বৃষ্টির কারণে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। কাজে যোগ দিতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন তারা। বৃষ্টির কারণে তেমন কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। ফলে ব্যবসায়ীরাও পড়েছেন চরম বিপাকে। অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দুপুর ১২টার পর খুলতে দেখা গেছে।

অন্যদিকে দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বগুড়ায় ১৪২ মিলিমিটারসহ সারাদেশে গত ২৪ ঘণ্টায় দেশে ২ হাজার ৫১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস।

অপরদিকে, পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে পৌর এলাকার শান্তিপাড়ার শতাধিক পরিবার। মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে শান্তিপাড়ায় দেখা গেছে, জলাবদ্ধতার কারণে এলাকার অধিকাংশ বাড়ির উঠোনে পানি জমেছে। গবাদি পশুগুলো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। পানিবন্দি পরিবারের লোকজনের রান্নার ব্যবস্থাটিও নেই।

শান্তিপাড়ার বাসিন্দা হারুন অর রশিদ বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন হতো পাড়ার মাঝদিয়ে বয়ে যাওয়া জোলে। জন্মের পর থেকেই তারা এটি দেখে আসছেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি নির্মাণ ও জোলে মাটি ভরাট করার কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বর্ষার মরসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।

মাহবুবুর রহমান বলেন, আমার মনে হয় পৌর এলাকার ২নং ওয়ার্ডের মধ্যে শান্তিপাড়ায় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত। সারাদেশে উন্নয়ন হলেও তার ছোঁয়া লাগেনি এ এলাকায়। নেই ড্রেনেজ ব্যবস্থা। তাছাড়া তুলনামূলক শান্তিপাড়ার কিছুটা নিম্নাঞ্চল এলাকায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের পথও নেই। ফলে শুধু এবারই নয়, প্রতিবছরেই সামান্য বৃষ্টিতে দুর্ভোগ পোয়াতে হয় এ এলাকার বাসিন্দাদের।

এলাকার এক গৃহবধূ বলেন, বাড়ির উঠোনে পানি জমেছে। এতে রান্না করতে পারছি না। জ্বালানি ভিজে আছে। গবাদি পশু রাখার জায়গা নেই। দুয়েক দিনের মধ্যে পানি না কমলে পরিবারের লোকজন নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে।

অটোচালক সজিবুল ইসলাম বলেন, ‘দৈনিক ৪৭০ টাকার বিনিময়ে অটো ভাড়া নিয়ে চালায়। বৃষ্টির কারণে মানুষজন বাহিরে বের হয়নি। তাই যাত্রীও তেমন নেই। আয় ইনকামও নেই। ভাড়ার টাকা উঠিয়ে তারপর আসবে লাভের হিসাব। যদি কোনো যাত্রী না পাই তারপরও তার এ ভাড়ার টাকা পরিশোধ করা লাগবে।’ দিনমজুর মসলেম উদ্দিন বলেন, ‘সারাদিন যা কাজ করি তার মজুরি দিয়ে চাল, ডাল নিয়ে বাড়ি ফিরি। বৃষ্টি হচ্ছে তারপরও কাজের সন্ধানে বের হয়েছি। যদি কোনো কাজ না পাই তাহলে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হবে।’

চুয়াডাঙ্গা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সামাদুল হক জানান, কয়েকদিন ধরেই থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। তবে নিম্নচাপের প্রভাবে মঙ্গলবার ভোর থেকেই অতিমাত্রায় বৃষ্টি শুরু হয় এবং দুপুর ১২টায় কিছুটা কমে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা চলতি বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত। এর আগে এ বছর বর্ষায় ভরা মরসুমে চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ৬২ মিলিমিটার।

তিনি আরও জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপের কারণে এই বৃষ্টিপাত। নিম্নচাপটি বর্তমানে লঘুচাপে পরিণত হয়েছে। মঙ্গলবার এবং বুধবার এই বৃষ্টি অব্যহত থাকবে। বৃষ্টির কারণে দিনের এবং রাতের তাপমাত্রাও হ্রাস পেয়েছে। মঙ্গলবার চুয়াডাঙ্গায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

আবহাওয়া অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সক্রিয় মরসুমে বায়ুর প্রভাবে বুধবার দুপুরের মধ্যে চট্টগ্রাম, বরিশাল, খুলনা, ঢাকা, রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারী (৪৪ থেকে ৮৮ মিলিমিটার) থেকে অতিভারী (৮৯ মিলিমিটার বা তারও বেশি) বর্ষণ হতে পারে।

এদিকে নিম্নচাপের প্রভাবে মেঘমালার সৃষ্টি অব্যাহত রয়েছে। তাই সমুদ্রবন্দরগুলো, উত্তর বঙ্গোপসাগর ও বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এজন্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরগুলোকে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

পূর্ণিমা ও বায়ুচাপ পার্থক্যের আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, ঝালকাঠি, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল, লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এবং তাদের অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে এক থেকে দুই ফুট অধিক উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। এ অবস্থায় উত্তর বঙ্গোপসাগর ও গভীর সাগরে অবস্থানরত মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত উপকূলের কাছাকাছি থেকে সাবধানে চলাচল করতে বলা হয়েছে। সেসঙ্গে তাদের গভীর সাগরে বিচরণ না করতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে রংপুর, দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, ঢাকা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, যশোর, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার এবং সিলেট অঞ্চলগুলোর ওপর দিয়ে দক্ষিণ/দক্ষিণ-পূর্বদিক থেকে ঘণ্টায় ৪৫-৬০ কিলোমিটার বেগে বৃষ্টি/বজ্রবৃষ্টিসহ অস্থায়ীভাবে দমকা/ঝড়ো হাওয়া বয়ে যেতে পারে। এসব এলাকার নদীবন্দরগুলোকে এক নম্বর সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

দামুড়হুদা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদায় ভারী বর্ষণে থৈ থৈ করছে ফসলের মাঠ ও গ্রাম। স্থবির হয়ে পড়েছে জনজীবন, গৃহপালিত পশু-পাখি। উপজেলার মাথাভাঙ্গা ও ভৈরব নদের পানির উচ্চতা ২ ফুট থেকে ৩ ফুট বৃদ্ধি পেয়েছে। ফসলের মাঠ ও বিভিন্ন গ্রামেও জমে আছে দেড় থেকে দুই ফুট পানি। মাটির ঘরের দেয়াল ধষে পড়ার অসংখ্যাও করছে অনেকে। তবে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়েছে নিম্ন আয়ের খেটে খাওয়া মানুষ, গৃহপালিত পশু পাখি।

এদিকে, দামুড়হুদা উপজেলা শহরের স্টার ক্লাবপাড়া, কুঠিরপাড়া, দশমী টহ বাজারপাড়া, স্টেডিয়াম মাঠপাড়া, হাতিভাঙ্গা, মোক্তারপুর, চিৎলা তেঁতুলতলা পাড়া, নতিপোতা ইউনিয়নের হেমায়েতপুর কবরস্থানপাড়া, হাউলী ইউনিয়নের তারিনীপুর মাঝপাড়াসহ আরও বিভিন্ন গ্রামের পাড়া-মহল্লায় হাটু পানি জমে থাকার চিত্র চোখে পড়েছে।

অপরদিকে, কৃষকরা রয়েছে চরম দুঃচিন্তায়। উপজেলার অধিকাংশ ফসলের মাঠ যেদিকেই চোখ রাখা যায় সেদিকেই থৈ থৈ পানি চোখে পড়েছে। ফসলের ক্ষেতে পানি জমে থাকায় দুঃশ্চিন্তার ভাজ পড়েছে কৃষকদের কপালে। কৃষকরা বলছেন, ফসলের ক্ষেতে জমা থাকা পানি দ্রুত সরে না গেলে ফসলের বিশাল ক্ষয়ক্ষতি হবে।

দামুড়হুদার হেমায়েতপুর কবরস্থানপাড়ার মাসুদ রানা জানান, প্রতি বর্ষা মরসুমে আমাদের পানিবন্দি জীবনযাপন করতে হয়। এই মহল্লায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় ২-৪দিন পর্যন্তও বৃষ্টির পানি জমে থাকে। আর ওই সময়টা আমাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।

দামুড়হুদার তারিনীপুর গ্রামের ভুক্তভোগী বিল্লাল হোসেন বলেন, প্রতি বর্ষা মরসুমে আমাদের মহল্লার ৩০-৪০টি পরিবারের পানিবন্দিভাবে জীবনযাপন করতে হয়। সুপরিকল্পনার অভাবে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা না থাকায় আমাদেরকে চরম দুর্ভোগ পোয়াতে হয়। বিশেষ করে বসত ঘরে পানি প্রবেশ করাই রাতে ঘুমোনো কষ্টের হয়ে পড়ে। সাপ পোকা মাকড়ের ভয়ে রাতে ঘুমোতেও পারি না।

কার্পাসডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়নের আরামডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভেতর ও যাতায়াতের একমাত্র রাস্তাটি পানিবন্দি। যার কারণে ভোগান্তিতে পড়েছে শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রমেও।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যালয়ের রাস্তাটি পানিতে থই থই করছে। পানি বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিদ্যালয়ের ভেতর পানিবন্দি। দেখে মনে হচ্ছে ছোট পুকুর। শিক্ষার্থীকে পানি ডিঙিয়ে হাঁটাচলা করতে দেখা গেছে। ভেজা শরীর নিয়ে ক্লাস করছে তারা। দিনের পর দিন এভাবে ভিজে তারা স্কুলে যাতায়াত করে। অনেক শিক্ষার্থী এই পরিবেশে স্কুলে আসতে ভয় পায়। ফলে শিক্ষা কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কার্পাসডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোক্তা হারুন অর রশিদ হারুন জানান। আরামডাঙ্গার একমাত্র স্কুলের রাস্তাটি দীর্ঘদিনের সমস্যা। সংস্কারের কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না কর্তৃপক্ষের। বৃষ্টি হলেই রাস্তার ওপরে জলাবদ্ধতার কারণে গ্রামের সাধারণ মানুষসহ বিদ্যালয়র শিক্ষার্থীরা চরম দুুর্ভোগের শিকার হয়। গতকাল অতিবৃষ্টির কারণে বিদ্যালয়টি পুকুরে পরিণত হয়েছে। রাস্তাটি সংস্কারের জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের সুদুষ্টি কামনা করেছেন। বিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটির সভাপতি শিক্ষক সাইফুল ইসলাম জানান, আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের যাতায়াতের একমাত্র রাস্তায় বৃষ্টির সময় অনেক দিন ধরে পানিবন্দি হয়ে থাকে। পানি নিষ্কাশনের কোন ব্যবস্থা থাকায় কোমলমতি শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এ সময় তারা পানি ডিঙ্গিয়ে স্কুলে যায়। পোষাক ভিজে যায় তাদের। স্কুলের শিক্ষার্থীরাসহ মহল্লাবাসি ভোগান্তিতে পড়েছে যাতায়াতের জন্য। যার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রমে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More