পরপর দুদিন চুয়াডাঙ্গায় দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড : রাতে আরও শীতের পূর্বাভাস

তীব্র শীতে বোরো বীজতলার ক্ষতি : ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও কাজ না হওয়ায় চারার সংকটের আশঙ্কা কৃষকদের

চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সংগঠনের তরফে শীতবস্ত্র বিতরণ
স্টাফ রিপোর্টার: পরপর দুদিন দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় রেকর্ড করা হয়েছে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলসহ বরিশাল এলাকায় তাপমাত্রা তরতর করে কমছে। তীব্র শীতে যবথবু অবস্থা। প্রবাহমান মুদু থেকে মাঝারি মাত্রার শৈত্যপ্রবাহ অব্যাহত থাকতে পারে। ৪৮ ঘণ্টার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাতের তাপমাত্রা আরও কমতে পারে। এদিকে চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর ও ঝিনাইদহে সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানসহ ব্যক্তি উদ্যোগে দুস্থদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রয়েছে।
অপরদিকে, তীব্র শীতে বোরো বীজতলার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও সন্তোষজনক ফল পাচ্ছেন না কৃষকরা। এ রকম পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে এবার এ জেলার বোরোর চারার সংকট দেখা দিতে পারে বলে কৃষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, উপ-মহাদেশীয় উচ্চচাপ বলয়ের বর্ধিতাংশ পশ্চিমবঙ্গ ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান করছে। মরসুমের স্বাভাবিক লঘুচাপ দক্ষিণ বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করছে। অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ সারা দেশের আবহাওয়া শুষ্ক থাকবে। শেষরাত থেকে সকাল পর্যন্ত সারা দেশের নদী অববাহকার কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ঘন কুয়াশা এবং দেশের অন্যান্য এলাকায় হালকা থেকে মাঝারি ধরনের কুয়াশা পড়তে পারে। খুলনা বিভাগসহ মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শ্রীমঙ্গল, রাজশাহী, ঈশ^রর্দী, বদলগাছি, দিনাজপুর, তেঁতুলিয়া, রাজারহাট, বরিশাল, খেপুপাড়া অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরণের শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং কিছু কিছু এলাকায় তা অব্যাহত থাকতে পারে। দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায় ৭ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হলেও যেসব অঞ্চলসমূহের ওপর দিয়ে শৈত্যপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে বরে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর, তার মধ্যে চুয়াডাঙ্গা কুষ্টিয়া নেই। তবে চুয়াডাঙ্গায় উত্তরের হিমেল হাওয়া কাপাচ্ছে প্রাণিকূলকে। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা গতকালও টেকনাফে ২৮ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। চুয়াডাঙ্গায় সর্বোচ্চ তামপাত্রা ছিলো ২৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকার তাপমাত্রাও হ্রাস পেয়েছে। রাজধানীতে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৮ ও সর্বনিম্ন ১৩ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়। যশোরে সর্বোচ্চ ২৬ দশমিক ৬, সর্বনিম্ন ৮ দশমিক শূন্য, কুষ্টিয়ার কুমারখারীতে সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ২ ও সর্বনিম্ন ১০ দশমিক শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ৫ দিনের আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। এদিকে তীব্র শীতে দিনে ঝলমলে রোদ পেয়ে গ্রামবাংলায় কুমড়ো কলাইর বাড়ি দেয়ার ধুম পড়েছে। শহর শহরতলি থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হতদরিদ্র্যদের মাঝে শতীবস্ত্র বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। নিম্নমধ্যবিত্ত বহু পরিবার রয়েছে যারা না পারেন হাত পাততে, না পারেন শীতবস্ত্র গায়ে চাপিয়ে একটু স্বস্তিতে থাকতে। এদিকেও বিশেষ নজর দেয়ার তাগিদ সচেতন মহলে। অবশ্য চুয়াডাঙ্গা জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের তরফে এধরণের দুস্থদের মধ্যেও শীতবস্ত্র বিতরণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
ডিঙ্গেদহ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, চুয়াডাঙ্গার শংকরচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে অসহায় শীতার্ত মানুষের মাঝে শীতবস্ত্র কম্বোল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শংকরচন্দ্র ইউনিয়ন পরিষদ চত্বর থেকে শীতবস্ত্র কম্বল বিতরণ করেন শংকরচন্দ্র ইউপি চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত হোসেন, শংকরচন্দ্র ইউপি প্যানেল চেয়ারম্যান শওকত মাহাম্মুদ, ইউপি সচিব ফয়জুর রহমান, পল্লী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ইলিয়াস হোসেন।
আলমডাঙ্গা ব্যুরো জানিয়েছে, তীব্র শীতে আলমডাঙ্গা উপজেলাসহ চুয়াডাঙ্গা জেলায় বোরো ধানের বীজতলা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কৃষকরা প্রচ- শীতের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বীজতলা রক্ষার জন্য বিভিন্ন প্রকার ছত্রাকনাশক ছিটিয়েও সন্তোষজনক ফল পাচ্ছেন না। বেশ কয়েক দিন ধরে চুয়াডাঙ্গা জেলাসহ দেশের পশ্চিমাঞ্চলে মাঝারি শৈত্যপ্রবাহ চলছে। গত ২৭, ২৮ ও ২৯ ডিসেম্বর দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় চুয়াডাঙ্গায় (৭.৯, ৭.৭ ও ৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। আগামী আরও কয়েক দিন তাপমাত্রার পারদ আরও নিম্নগামী থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। এ রকম পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে এবার এ জেলার বোরোর চারার সংকট দেখা দিতে পারে বলে কৃষকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
বিভিন্ন গ্রামের কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পৌষ মাস শুরুর আগেই অর্থাৎ অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামাঝিতেই তারা বীজতলায় ধানের বীজ বুনেছেন, সেগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে কেউ কেউ কিছুটা দেরিতে অর্থাৎ পৌষের শুরুতে বীজতলা তৈরি করেছেন। বিলম্বের বীজতলাগুলোর ক্ষতি অপেক্ষাকৃত অধিক। ধানের দাম ভালো থাকায় ধান চাষের প্রতি এ এলাকার কৃষকদের আগ্রহ বেড়েছে।
অনুপনগর গ্রামের কৃষক হাসানুর রহমান বলেন, ‘ব্রি-৬৩, ৫০ ও ৮১ জাতের তিন মণ ধানের বীজতলার অর্ধেকই অতিরিক্ত শীতে নষ্ট হয়েছে। নতুন করে বীজতলা তৈরি করতে হবে। প্রতিদিন শীতের তীব্রতা বাড়ছে। তাই দুশ্চিন্তায় আছি।’
বাদেমাজু গ্রামের জিল্লু হোসেন জানান, ‘স্বর্ণ ও ধানী গোল্ড জাতের ১৫ কাঠা বীজতলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। অতিরিক্ত শীতে পাতো (চারা) লালচে হয়ে গেছে। পাতোর (চারা) পাতার মাথা শুকিয়ে যাচ্ছে। বীজতলা নষ্ট হয়ে গেলে ধান লাগাবো (রোপণ) করবো কী করে?”
দীঘলডাঙ্গা, চরপাড়া, মধুপুর ও বার ঘরিয়া গ্রামের চাপোড় গ্রামের কৃষক শের আলী, শুকুর আলী, নেকবার ম-ল, সরকার আলী, তুফান ম-ল, হারেজ আলী, আব্দুল জব্বার জানান, তারা ক্ষতিগ্রস্ত বীজতলায় স্কোর, ডুডু, সিনজেনটার থিওভিটসহ বিভিন্ন ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করছেন। কিন্তু সন্তোষজনক ফল পাচ্ছেন না।
গত ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর আলমডাঙ্গা উপজেলার জোড়গাছা, ঘোলদাড়ি, জাহাপুর, বেলগাছি, অনুপনগর, শালিকা, দীঘলডাঙ্গাসহ বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত বীজতলা দেখা গেছে। তীব্র শীতের প্রচ-তা থেকে বীজতলা রক্ষা করতে কোনো কোন কৃষক পলিথিন দিয়ে বীজতলা ঢেকে দিয়েছেন। অনেকে আবার বিচালি (খড়) দিয়ে ঢেকেছেন। তবে তাতেও ক্ষতি থেকে রক্ষা করা যাচ্ছে না বীজতলাকে।
আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি অফিসসূত্রে জানা যায়, এ বছর আলমডাঙ্গা উপজেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০৬৯০ হেক্টর। চুয়াডাঙ্গা জেলায় ৩৩৪২৫ হেক্টর। আলমডাঙ্গা উপজেলায় ৬৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো বীজতলা তৈরি করা হয়েছে।
আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা সোহেল রানা জানান, ‘অপেক্ষাকৃত বিলম্বে বোপণ করা বীজতলাগুলোর চারা তীব্র শীতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তবে এ ক্ষতি খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। প্রচ- শীতের পাশাপাশি রোদও হচ্ছে। ফলে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে না।’
আলমডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলেন, ‘তীব্র শীতে বীজতলার ক্ষতি হলেও চারার সংকট খুব বেশি হবে না। কৃষকরা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি বীজতলা তৈরি করেন।’
জীবননগর ব্যুরো জানিয়েছে, জীবননগর উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শীতার্ত মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় উথলী ইউনিয়নের শিয়ালমারী গ্রামের আদিবাসী পল্লীর দরিদ্র ও অসহায় অর্ধশতাধিক মানুষের মাঝে কম্বলগুলো বিতরণ করেন জীবননগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম মুনিম লিংকন। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন জীবননগর উপজেলায় সদ্যযোগদানকারী জীবননগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. মহিউদ্দীন, উথলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. আব্দুল হান্নান, উথলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারক সোহেল আহম্মেদ প্রদীপ, প্রচার সম্পাদক সেলিম হোসেন, ৬নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আমিনুল ইসলাম প্রমূখ।
উল্লেখ্য, গত এক সপ্তাহ ধরে জীবননগরে প্রচ- শীতের কারণে জনজীবন একেবারে স্থবির হয়ে পড়েছে। হাড় কাঁপানো শীতে ছিন্নমূল মানুষরা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। এ কারণে সরকারিভাবে এবং বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ছিন্নমূল মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র হিসেবে কম্বল বিতরণ করছেন।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More