মোবাইলফোনে ডেকে ঘুমের ওষুধ খাওয়ানোর পর শ্বাসরোধ করে হত্যা

চুয়াডাঙ্গার যদুপুরে প্রবাসীর ছেলে অপহরণ : গ্রেফতারকৃতদের স্বীকারোক্তিতে অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার
নজরুল ইসলাম: মা আমার শরীরটা ভালো নেই। আমাকে খেতে দাও, ঘুমাবো। এরই মধ্যে বেজে উঠলো মোবাইলফোন। খাবার রেখে বাড়ি থেকে বের হয় কিশোর শাকিব। রাত শেষে ভোরের আলো ফুটে উঠলেও ছেলে শাকিবের দেখা পাননি মা শেফালী বেগম। ছেলে শাকিবকে ফেরত পেতে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে ফোন করা হয়। পুলিশকে জাননোর পর বিষয়টি সাধারণ ডায়রিভুক্ত করে দর্শনা থানা পুলিশ। এরপর একে একে কেটে গেলো সাতটি দিন। এরইমধ্যে জড়িত সন্দেহে কয়েকজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের স্বীকারোক্তিতে সাতদিন পর উদ্ধার করা হলো কিশোর শাকিবের লাশ। বলা হচ্ছে চুয়াডাঙ্গার যদুপুর গ্রামের কিশোর শাকিবের কথা। অপহরণের সাতদিন পর গতকাল শনিবার দুপুরে গ্রামের আমবাগান থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ওই বাগানে গর্তের ভেতরে জ্বালানি খড়ি ও পাতা দিয়ে ঢেকে রাখা অর্ধগলিত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ময়নাতদন্তের জন্য লাশ চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। আজ রোববার ময়নাতদন্তের পর শাকিবের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
এদিকে, এ ঘটনার মুলহোতা কুষ্টিয়ার রাজিবসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মুক্তিপণ নাকি অন্য কারণে শাকিলকে ফোনে ডেকে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে তা নিশ্চিত হতে তদন্ত অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
জানা গেছে, চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার বেগমপুর ইউনিয়নের যদুপুর গ্রামের মাঠপাড়ার সৌদি প্রবাসী আব্দুল কুদ্দুসের ছেলে শাকিব হোসেন ওরফে শাকিল আহম্মেদ (১৫) গত ১৯ ডিসেম্বর শনিবার রাত ৮টার দিকে তার মাকে ভাত দিতে বলে। খাওয়ার আগ মুহূর্তে একটি ফোন পেয়ে খাবার রেখে বাইরে চলে যায়। পরদিন সকালে শাকিলকে ফেরত পেতে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ চেয়ে তার মা শেফালী বেগমের কাছে ফোন করা হয়। পরদিন সকালে বিষয়টি দর্শনা থানা পুলিশকে জানানোর পর সাধারণ ডায়রিভুক্ত করা হয়।
পুলিশ জানিয়েছে, প্রযুক্তির সহায়তায় অপহরকদের গ্রেফতার ও শাকিবকে উদ্ধার করতে অভিযান শুরু করা হয়। সন্দেহভাজন চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের স্বীকারোক্তিতে শনিবার দুপুর ১২টার দিকে যদুপুর গ্রামের মোল্লাবাড়ির আমবাগানের একটি গর্তের ভেতর থেকে শাকিবের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতারকৃতরা হলেন কুষ্টিয়া মিরপুরের কামিরহাট ক্যানালপাড়ার কুদ্দুস ম-লের ছেলে হত্যাকা-ের মুলহোতা রাজিব ম-ল (২৪), যদুপুর গ্রামের আকরাম বকাইলের ছেলে সিদ্দিকুর রহমান (৪২), যশোরের শার্শা উপজেলার উলাশি গ্রামের ঈমন আলীর ছেলে আকাশ (২৫) ও ওমর আলীর ছেলে সোয়েবকে (১৯) গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত চারজনকে আজ রোববার আদালতে সোপর্দ করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
পিতা প্রবাসে থাকায় কখনও রাজমিস্ত্রী আবার কখনও মাছ বিক্রি করতো নিহত শাকিব। দু’মাস আগে যদুপুর গ্রামের সিদ্দিকের ছেলে সুমনের সাথে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতে ঝিনাইদহে যায় সে। সেখানে কাজ করার সুবাদে পরিচয় হয় কুষ্টিয়া মিরপুরের কামিরহাট গ্রামের রাজিব ম-লসহ সমবয়সী কয়েকজনের সাথে। তাদের মধ্যে রাজিব কয়েকদিন আগে যদুপুর গ্রামে সুমনের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলো।
দর্শনা থানার ওসি মাহাব্বুর রহমান কাজল বলেন, ঘটনার রাতেই অপহরণকারীরা শাকিবকে কোমল পানীয়’র সাথে ২৫টি ঘুমের ওষুধ খাইয়ে যদুপুর গ্রামের মোল্লাবাড়ির আমবাগানে নিয়ে যায়। পরে সেখানে শাকিবের গায়ের গেঞ্জি দিয়ে গলায় ফাঁস লাগিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার পর শাকিবের মায়ের কাছে মোবাইলফোনে ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করতে থাকে। অপহরণকারীরা একবার কুষ্টিয়া, একবার যশোর, একবার ঢাকার ঠিকানা বলে তাকে ঘুরাতে থাকে। তিনি আরও বলেন, গ্রেফতারকৃত রাজিব একজন পেশাদার অপরাধী। শাকিলের পিতা প্রবাসী। তাকে অপহরণ করলে মুক্তিপণ হিসেবে টাকা পাওয়া যাবে এমন ধারণা থেকেই তারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে। আরও তদন্তের মাধ্যমে এর প্রকৃত ঘটনা জানা যাবে।
সন্তান হারানোর শোকে কাতর মা শেফালী বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ঘটনার রাতে শাকিব আমাকে ভাত দিতে বলে। ভাত দিই। খেতে বসবে, এমন সময় ফোন পেয়ে বাড়ির বাইরে চলে যায়। সেই যে গেলো আর ফিরে আসেনি।
নিহত শাকিবের পিতা সৌদিআরব প্রবাসী। মা ও ৮ বছরের বোনকে নিয়ে তাদের সংসার। পিতা প্রবাসে যাওয়ার পর থেকে সংসার চালাতে কখনও রাজমিস্ত্রী আবার কখনও মাছ বিক্রির কাজ করতো শাকিব। মিষ্টভাষী শাকিব এলাকার মানুষের কাছে প্রিয়পাত্র ছিলো। তাকে হত্যা করা হতে পারে এটা কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। শাকিবের লাশ উদ্ধারের পর থেকে পরিবারজুড়ে যেমন চলছে শোকের মাতম, তেমনি গ্রামে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। সেই সাথে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও জানিয়েছে এলাকাবাসী।
চুয়াডাঙ্গা পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম বলেন, অপহরণের বিষয়টি জানার পর প্রযুক্তি ব্যবহার করে সন্দেহভাজনদের গ্রেফতার করা হয়। তারা ঘটনা স্বীকার করেছে। তাদের কথা মতো লাশ উদ্ধার করা হয়। প্রকৃত ঘটনা জানতে পুলিশি তদন্ত অব্যাহত রয়েছে।
এদিকে, এটা কি মুক্তিপণের কারণে হত্যা, না কি অন্য কিছু এ নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

এছাড়া, আরও পড়ুনঃ

This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More